[:bn]আশা-আকাঙ্ক্ষা[:]

[:bn]আশা-আকাঙ্ক্ষা[:]

October 15, 2018

[:bn]

আজও স্কুল থেকে ফিরে একরাশ বিরক্তি নিয়ে নিজের বিছানায় চুপ করে বসেছিল জয়িতা। কিছু ভালো লাগছে না তার। দূর, এইভাবে দিনের পর দিন এই যন্ত্রণা সহ্য হয়? ছোট থেকে কত সাধ ছিল স্কুল-টিচার হবে। পড়াতে সে খুব ভালোবাসে। বাড়িতে মাথায় ওড়না বেঁধে লম্বা চুল বানিয়ে ছোটবেলায় কতই না ‘দিদিমণি’,‘দিদিমণি’ খেলেছে, আর ঠাম্মার ঘরের জানালা ভরিয়েছে চক দিয়ে লিখে। আর এখন কিনা সেই দিদিমণি হবার শখ মেটাতেই তাকে নিজের বাড়ি ছেড়ে, মা- বাবা- ঠাম্মাকে ছেড়ে এতদূর পড়ে থাকতে হচ্ছে। সাধ ছিল ভালো স্কুলে পড়াবে, ঝাঁ-চকচকে স্কুলবাড়ি, দারুণ সব ছাত্রছাত্রী। কিন্তু কপাল খারাপ ছিল বলেই তো আজ তাকে কুলতলি অঞ্চলের এই অনামী স্কুলটাতে পড়াতে আসতে হল। কলকাতায় বড় হয়েছে সে। লেখাপড়াও করেছে নামী- দামি স্কুল- কলেজ। এই দরিদ্র গ্রামের পরিবেশে সে বড়ই অস্বচ্ছন্দ বোধ করছে। তার ওপর আবার স্কুলের কাছাকাছি থাকবার জায়গাও নেই। বাধ্য হয়ে তাকে সোনারপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হচ্ছে তারই এক সহকর্মী অঙ্গিরার সঙ্গে। জয়িতার মোটেই পছন্দ হয় না এই চাকরি জীবন। স্কুল শেষে বাসায় ফেরার পর কেমন একটা একাকিত্বের কুয়াশা ঢেকে ফেলে তাকে।
স্কুলের অবস্থা আরো খারাপ। ছাত্র- ছাত্রীরা কেউই তেমন মনোযোগী নয় কয়েকজন ছাড়া। অর্ধেকদিন পড়া করে আসে না। তাদের পোশাক- আশাক বড়ই অপরিচ্ছন্ন। ভালো লাগে না জয়িতার। এদের পড়ানোর স্বপ্ন কি সে আদৌ দেখেছিল কখনও?
পাশের বিছানায় নিজের পড়া করছিল অঙ্গিরা। জয়িতার এই মনমরা ভাবটা যে তার মধ্যেও নেই এমন নয়। তবে সে বড়ই বাস্তববাদী। তাই সে জোরকদমে লেখাপড়া চালাচ্ছে যাতে আবার পরীক্ষা দিয়ে ভালো জায়গায় চাকরি পেতে পারে। সে আড়চোখে লক্ষ করছিল জয়িতাকে। হঠাৎ বলে ওঠে, কিরে? মুখটা অমন গোমড়া-থেরিয়াম কেন? একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ে জয়িতার গলায়, আর বলিস না, ক্লাস এইটে কবে থেকে বলছি জীবন- বিজ্ঞানের রেফারেন্স বই কিনতে। লেখকের নাম বলে দিয়েছি। কিন্তু কী অবাধ্য। কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগই কেনেনি। না কেনার সেই একই অজুহাত- ‘অত টাকা নেই দিদিমণি’। কী বিরক্ত যে লাগে। বই নেই, খাতা নেই, কী করে পড়াই বল তো?
সব শুনে অঙ্গিরা বলে, ঠিকই বলেছিস। আমার ভূগোল ক্লাসেও একই অবস্থা। একটা ম্যাপ বই কিনতে পারে না। এদের লেখাপড়া হবে না। আমি বুঝে নিয়েছি। তাই আমি বলি কি তুইও আমার মত আবার পড়ায় মন দে। আবার স্কুল- সার্ভিস পরীক্ষা দে। ভালো স্কুলে পেয়ে যেতে পারিস।
অঙ্গিরার বাস্তবমুখী চিন্তা- ভাবনা নাড়া দেয় জয়িতাকে। সত্যিই এবার পরীক্ষা দিয়ে চেষ্টা করতে হবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে।
পরদিন ক্লাসে পড়া ধরছিল জয়িতা। বেশিরভাগই পড়া পারছে না। তাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সে। এটা রোজের চিত্র। এর পরের প্রশ্ন যে মেয়েটিকে করা হয় জয়িতা থাকে একেবারে সহ্য করতে পারে না। কোনোদিন পরিষ্কার জামা পরে আসে না। স্কুলেও রোজ আসে না। লেখাপড়াতেও ভালো না। মেয়েটির নাম আশা। আজও যথারীতি পড়া বলতে না পেরে বোবার মতো দাঁড়িয়ে রইল সে। কিন্তু জয়িতা আজ নিজের সুপ্ত ক্রোধকে আর সংযত রাখতে পারল না। উঠে গিয়ে কান ধরে ঠাস করে এক চড় মারল আশার গালে। তারপর বার করে দিল ক্লাসের বাইরে। বলল, লেখাপড়া না করে আমার ক্লাসে ঢুকবে না। মনের রাগ কি একটু কমল তার?
এর ক’দিন পরের ঘটনা। ক্লাস শেষের পর টিচার্সরুমে ঢুকে জয়িতা শুনল কীসব ঝামেলা হয়ে হঠাৎ ট্রেন বন্ধ হয়ে গেছে। আজ আর ট্রেন চলার সম্ভাবনা নেই। হেডস্যার অমিতাভবাবু আসেন নিজস্ব গাড়িতে। তিনিও বয়ঃজ্যেষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষক- শিক্ষিকাকে, যাঁরা দূরে থাকেন তাঁদের নিজের গাড়ি করে পৌঁছে দেবেন ঠিক হয়েছে। গাড়িতে আর জায়গা নেই। যাঁদের কাছে বাড়ি, তাঁরাও নিজেদের বাড়ির পথ ধরলেন। কিন্তু জয়িতা এখন কী করবে? তার কথা তো কেউ ভাবছেনই না। অঙ্গিরার জ্বর হয়েছে। সে তো আজ আসতে পারেনি স্কুলে। যাঁদের কাছে বাড়ি তাঁরাও তো তাকে একবারও এই বিপদে নিজেদের বাড়িতে একটা রাত আশ্রয় দেবার কথা বলছেন না? তবে কি সে নিজে একবার বলবে কাউকে? কিন্তু তাঁরাও যদি মুখের উপর না বলে দেন? সে ভারি অপমানজনক হবে। জয়িতার আত্মসম্মান জ্ঞান বড় প্রখর।
সবাই যে যার মত টিচার্সরুম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সেও চুপচাপ উঠে গেটের দিকে পা বাড়ায়। চোখ ফেটে জল আসে জয়িতার। গেট দিয়ে বেরিয়ে দেখে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। আশা না? লাজুক মেয়েটা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলে, দিদিমণি, একটা কথা বলব? রাগ করবেন না তো? বিরক্ত জয়িতা বলে, তোমার কথা শোনার সময় আমার নেই। দেখছ একটা প্রবলেমে… তাকে প্রায় থামিয়ে দিয়ে আশা বলে, জানি দিদিমণি, তাই তো বাড়ি যাইনি। আপনার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি। আপনি যাবেন দিদিমণি আমাদের বাড়ি? আপনার খুব কষ্ট হবে জানি। তবে একটা তো রাত। যাবেন?
থমকে গেছে জয়িতা। আশা তারই জন্য দাঁড়িয়ে ছিল? তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য? কৃতজ্ঞতায় বোবা হয়ে যায় জয়িতা। আশার সারল্য আর মানবিকতার সামনে খর্ব হয়ে যায় তার অহংকার।
জয়িতা আশার সঙ্গে ওদের বাড়িতে আসে। দুটো ছোট ছোট মাটির ঘর ওদের। ওর বাবা অসুস্থ। শয্যাশায়ী। চারটি ছোট ভাইবোন। ওর মা পরিচারিকার কাজ করেন। তিনিও বড়ই দুর্বল। যেদিন কাজে যেতে পারেন না আশাকেই যেতে হয় তাঁর জায়গায়। এসব কথা জয়িতা মুড়ি খেতে খেতে শুনছিল আশার মায়ের কাছে। আশার মা বলেন, জানেন দিদি, আশার খুব নেকাপড়া করার ইচ্ছে। কিন্তু যেমন কপাল। বাড়ির সব কাজ করে মেয়েটা। কখন পড়বে বলুন? বইখাতাও দিতে পারিনে। দেব কোথা থেকে? দু’বেলা ভাত জোটে না। হয়তো ক’দিন পর ইস্কুল ছেড়ে দিতে হবে।
দু’চোখ জলে ভরে গিয়েছিল জয়িতার। আত্মগ্লানিতে, বেদনায় এবং সন্তাপে। কত ভুল বুঝেছে সে এই মানুষগুলোকে। আজ এই পরিস্থিতিতে না পড়লে সে তো ভুলই করে যেত। সে নিজে বড় বিলাসিতায় মানুষ। তাই জানতেও পারেনি তাদের মতো সুখ- নিরাপত্তা-বিলাসিতার জীবনের বাইরে অন্যরকম একটা জগত থাকতে পারে, যেখানে পথ গোলাপ বিছানো হয় না। কণ্টকময় হয়। আজকে এই কঠোর বাস্তব তার স্বপ্নময়তাকে ভঙ্গ করে। সে প্রকৃত বাস্তব জীবনকে উপলব্ধি করে। বুঝতে পারে এই মানুষগুলো দুঃখে-কষ্টে জেরবার, তবু কত মানবিক, কত উদার।
পরদিন বাসা-বাড়িতে ফিরে চুপ করে শুয়েছিল জয়িতা। অঙ্গিরা বলে, কিরে পড়তে বসবি না? স্কুল-সার্ভিসের পরীক্ষা তো সামনে।
খুব স্বাভাবিক গলায় জয়িতা বলে, নারে, পরীক্ষা দেব না।
জয়িতার স্বর দৃঢ়, ঠিকই বলছি। আমি এই স্কুলটাতেই পড়াব। এতদিনে মোহভঙ্গ হয়েছে আমার। বাস্তবের মুখোমুখি পড়ে আমি জীবনকে চিনতে শিখেছি। আমি এখানকার ছেলেমেয়েদের পড়াব। মানুষ করে তুলব। আমার বাবার তো টাকার অভাব নেই। তাই আমার মাইনের টাকাটা এদের বই- খাতা- খাবার কিনতে খরচ করব। তা দিয়ে কিছু ছেলে-মেয়ের তো উপকার হবে। এতদিন সব আশা-আকাঙক্ষা নিজেকে ঘিরেই ছিল। বড় স্বার্থপর ছিলাম। আর বুঝলাম জীবনটা পরার্থে। বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়েই মানুষকে চেনা যায়, নিজেকেও চেনা যায়। বাস্তবই চিনিয়ে দেয় জীবনের স্বরূপ।
জয়িতার কথায় অঙ্গিরার মতো অতিরিক্ত বাস্তববাদী মেয়েও কেমন চুপ করে যায়। তারপর বলে ওঠে, এতদিন বড় বেশি স্বার্থপর ছিলাম। আজ তুই আমার চোখ খুলে দিয়েছিস। আমারা সবাই বড় আত্মসুখী, তাই শুধু নিজেদের ভালোটাই চাই। কারো জন্য ভালো করতে হলে নিজেদের স্বার্থকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়। আজ আমিও বুঝলাম জীবনের মানে। আমিও তোর হাত ধরে গড়ে তুলব এখানকার ছেলেমেয়েদের। আমাকে তোর যাত্রাপথের সঙ্গী করবি জয়িতা।
অঙ্গিরাকে জড়িয়ে ধরে জয়িতা। দুই বান্ধবীরই চোখে আনন্দাশ্রু তবু মুখে খেলে যায় এক অনাবিল হাসি।

– মহুয়া ঘোষ

[:]