[:bn]নিরানব্বই থেকে একশো[:]

[:bn]নিরানব্বই থেকে একশো[:]

September 26, 2018

[:bn]ওরে ও ন্যাদা, ন্যাদারে,- একবার নীচে আয়। মায়ের ডাকে ন্যাদা ছাদ থেকে চেঁচিয়ে বলে, কী হল? সাতসক্কালে এতো ডাকাডাকি কেন?
তোর ছোটমাসির ফোন।
ছোটমাসির নামে ন্যাদার মুখে হাসি ফোটে। মাসি থাকে নিস্তারিণীপুরে, এক অজ পাড়াগাঁ। বালি থেকে দুর্গাপুর হয়ে যেতে হয়। তবে অবস্থা ভালো। বাড়ির লাগোয়া বিরাট বাগান- আম, জাম,লিচু, কাঁঠাল গাছে ভর্তি। প্রতি বছর এসময়টা ওখানে তার নেমন্তন্ন বাঁধা।
একদিকে মা নন্দরানির আদরের দুলাল, অন্যদিকে মাসি ক্ষেমঙ্করীর নয়নের মণি। এর ফলে যা হয়- ছিল পাতিলেবু, হল বাতাবি। আগে নাম ছিল নবীন। খাওয়ার চোটে পেট মানে নাদা বেড়ে হল ইয়া ভুঁড়ি। নবীন হয়ে গেল ন্যাদা। এতেও মা মাসির চোখে ন্যাদা নাকি দিনদিন রোগা হয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ বাবা ভোম্বল বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন।– কী করছ তোমরা। খাইয়ে খাইয়ে এই বয়সেই ছেলেটাকে ভুঁড়িদাস বানিয়ে দিলে? পেট মোটার সঙ্গে মাথাটাও যে দিনদিন মোটা হয়ে যাচ্ছে। প্রতি ক্লাসেই দু’তিন বছর করে গুঁতিয়ে-গাঁতিয়ে এদ্দিনে ক্লাস নাইন। ওর ছোটবেলার বন্ধুদের দেখো, এর মধ্যে কলেজের পড়া শেষ করতে চল্লো। ক্ষেমঙ্করী বলেন, দেখুন জামাইবাবু, নিউটনও স্কুলজীবনে মাথামোটা ছিলেন। সময় হলেই দেখবেন ও ঠিক তেড়েফুঁড়ে উঠবে।
তা ন্যাদা, শেষ পর্যন্ত তেড়েফুঁড়েই উঠল। হঠাৎ একদিন, দুত্তরি নিকুচি করেছে ভুঁড়ির বলে, আদা –ছোলা-গুড় খেয়ে ব্যায়াম করতে লেগে গেল। ক’মাসেই ভুঁড়ি ভ্যানিশ। ন্যাদার বুকে হাতে পায়ে পেটে এখন শুধু মাশল কিলবিল করছে।
দুদ্দাড় ছাদ থেকে নেমে ন্যাদা মার হাত থেকে মোবাইলটা একরকম ছিনিয়েই নেয়। মাসির কন্ঠস্বর ভেসে আসে, শোন, তুই আজই চলে আয়। কাল থেকে আম পাড়া শুরু হয়েছে। তুই ছাড়া এত আম খাবে কে। দুটো কাঁঠালও পেকে এল। মাসি বলছে, আর ন্যাদা দিবাচোখে সব দেখতে পাচ্ছে, গন্ধ পাচ্ছে।
মাসি ফের বলেন, বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম, দুটো গাছে লিচুতে রং ধরেছে।
আজ রোববার, ট্রেনে ভিড় কম। জানালার ধারে হাওয়ার দিকে সিট পেয়ে ন্যাদা দারুন খুশি। ফুরফুরে মিষ্টি হাওয়া আসছে। ন্যাদার গানের মুড এসে যায়। কীর্তনের ঢংয়ে গুনগুন করে গান ধরে, ওরে আম- এবার তোকে খাব। চাকলা কেটে, কামড়ে কামড়ে, নিংড়ে চুষে চটকে খাব। ওরে আম এবার…।

হঠাৎ বেসুরো ভাঙা কাঁসির মতো কন্ঠের এক ফেরিওয়ালার চিৎকারে ন্যাদার স্বপ্নজগৎ ছিন্ন হয়। খ্যাংরা কাঠি আলুর দম মার্কা লোক কালো লম্বা একটা লোক, কাঁধে কাপড়ের ঝোলা, হাতে কটা কাগজের প্যাকেট। আঙুলের খাঁজে খাঁজে বেশ কায়দা করে ধরা। ফেরিওয়ালা চেঁচাচ্ছে- মশা মারুন, মশা মারুন। চারদিক ছেয়ে গেছে ম্যালেরিয়া আর ডেঙ্গুতে। হাসপাতালে লাইন, শ্মশানেও লাইন। এর মূলে শুধু ঐ ছোট্ট খুদে শয়তানরা। মাত্র এক টাকায় একটা পুরিয়া- অব্যর্থ ওষুধ। বাড়িতে ঠাকুরের ছবিতে তিনবার ঠেকিয়ে তবেই খুলবেন। তার আগে খুলবেন না। ঝড়ের গতিতে লোকটার ব্যাগ খালি। ন্যাদাও এক টাকা দিয়ে একটা প্যাকেট নিয়েছে। বাড়িতেও তো খুব মশা, মা খুশি হবে।
বালিতে নেমে ন্যাদা ঠিক করে হেঁটেই যাবে। হোক না দুর- আজ তাড়াতাড়ি বেরুতে গিয়ে জগিং করা হয়নি। ওটা ওয়াকিঙয়ে পুষিয়ে নেবে। নিস্তারিণীপুরে এসে ন্যাদা অবাক। চারিদিকে জোর কর্মব্যস্ততা। কোদাল,কাটারি,খুরপি,বালতি,ঝুরি নিয়ে দলে দলে ছেলে,বুড়ো,যুবা সব পথে নেমে পড়েছে। আগাছা, ঝোপঝাড় কেটে সাফ হচ্ছে। গর্ত,ডোবা, নালা,ন্রদনায় ব্লিচিং পাউডার ছেটানো, ডি. ডি. টি. স্প্রে করা হচ্ছে। যাকে বলে এলাহি কান্ড, ধুন্ধুমার ব্যাপার। এ গ্রামে অনেকেই ন্যাদাকে চেনে। নন্টেকে দেখে ন্যাদা এগিয়ে যায়।– হ্যাঁরে নন্টে, কী ব্যাপার রে?
আরে মাশলদা, তুমি? নন্টে একগাল হাসে। কাগজে পড়নি চারিদিকে ম্যালেরিয়া- ডেঙ্গু হচ্ছে। আজ রোববার, ছুটি। তাই সবাই মিলে মশক নিধন যজ্ঞ করছি। ওদের উৎস ধ্বংস করছি। গ্রামপ্রধানও ঘোষণা করেছেন, একশোটা মশা মেরে দেখালে, নগদ একশো টাকা পুরস্কার।
ন্যাদা মনে মনে ঠিক করে পুরস্কারটা তাকে নিতেই হবে। তার কাছে আছে মশা মারার অব্যর্থ ওষুধ। ভাগ্যিস কিনেছিল- এক টাকায় একশো টাকা।
ন্যাদাকে দেখে মাসি একগাল হেসে বলেন, আয়, তোর জন্যেই বসে আছি। খাটের তলাগুলো দ্যাখ- সব ঠাসা। খা যত খুশি- আগে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হ।
গুড,ভেরি গুড। দাও, আগে খেতে দাও। হাত-মুখ ধোয়া পরে- খেলেই ফ্রেশ হয়ে যাব।
তাহলে তাই চ। তোকে এখন বরং টেবিলেই দি। দুপুর আর রাতের খাওয়া মেঝেতেই বসে খাই। দেশি স্টাইল,-তোর মেসোর শখ।
টেবিলে বসে খেতে খেতে ন্যাদা বলে, তোমাদের এখানে খুব মশা, না? মাসী বলেন, খু-ব। ইয়া বড় বড় সব ডাঁশ মশা। দিনের বেলাতেও কামড়ে শেষ করে দিচ্ছে। আসার সময় দেখিসনি? সব তো শক্ত হৈ হৈ করে গেল। ন্যাদা মনে মনে বলে, যাক না- কত মারবে। আমার পকেটে আছো মশা মারা অ্যাটম বম। মশাদের বংশ হবে এতে ধ্বংস।
একপেট আম ঠেসে, আমের গন্ধমাখা একটা লম্বা ঢেঁকুর তুলে ন্যাদা নিজের নির্দিষ্ট ঘরে এসে দরজা দেয়। মশা মারার ওষুধটা খুলে দেখতে হবে। দেওয়ালে নটরাজের ছবিতে প্যাকেটটা ঠেকিয়ে ন্যাদা প্যাকেটটা খোলে। ভেতরে আর একটা প্যাকেট-ওপরে লেখা, ‘চলরে চলরে চল’। মানে? ন্যাদা অবাক। তাড়াতাড়ি দ্বিতীয় প্যাকেটটা খুলতেই বেরোয় তৃতীয় প্যাকেট। ওপরে লেখা ‘কেন পান্থ ক্ষান্ত হও, হেরে দীর্ঘ পথ’। তৃতীয়ের পর চতুর্থ- ওতে লেখা, ‘উদ্যম বিহনে কার পুরে মনোরথ’। ন্যাদা এবার মজা পায়। চতুর্থ খুলতেই বেরোয় পঞ্চম প্যাকেট। ওপরে লেখা ‘আপনা হাত জগন্নাথ’। পঞ্চম খুলতেই আসে ষষ্ঠ প্যাকেট। ওপরে কিছু লেখা নেই। প্যাকেটের ভাঁজ খুলে ন্যাদার আক্কেল গুড়ুম। ভেতরে পরিষ্কার বড় বড় অক্ষরে লেখা- ‘ধরো আর মারো’। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে ন্যাদা কাগজগুলো হাতে নিয়ে থ্যাবড়া মুখে বসে থাকে। আচ্ছা ঠকিয়েছে তো লোকটা। যদি কোনোদিন দেখা পাই পেঁদিয়ে ধনেপাতার চাটনি বানাব।
ব্যাজার মুখে নিজের ঘর থেকে মাসির ঘরে যেতে গিয়ে টেবিলের ওপর নজর পড়ে। তার খাওয়া আমের আঁটিগুলোর একটাতে কালো কালো কী দুটো বসে আছে না? মশা। আরেব্বাস কী সাইজ। ন্যাদা গুটিগুটি টেবিলের কাছে আসে। মশা দুটোর ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা নির্বিষ্টচিত্তে আঁটির গায়ে লেগে থাকা আমের রস চুষছে। ন্যাদার মাশল হাতের বিশাল চড় চকিতে নেমে আসে। বিকট শব্দে টেবিল কেঁপে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে মাসির আর্তনাদ- ‘ওরে বাবারে, মরে গেলুম। ওরে ন্যাদা, দেখ না, কোন হাড়হাভাতে আঁটি ছুড়ে মারল। ঝাঁটা মারো, ঝাঁটা মারো’- চোট খেয়ে মাসির কান্নাভেজা কন্ঠে গ্রাম্য গালাগাল বেরিয়ে এসেছে। আসলে ন্যাদার বিরাশি সিক্কা চড়ের চোটে আমের আঁটিটা টেবিল থেকে পিছলে রকেটের গতিতে মাসির ঘরের খোলা দরজা দিয়ে, সোজা মাসির কপালে। সঙ্গে সঙ্গে কপাল ফুলে আলু। মাসিকে তো এসব বলা যাবে না। ন্যাদা মাসির কোল থেকে আঁটিটা নিয়ে বলে, ফ্রিজ থেকে বরফ দাও। আমি দেখি কে ছুঁড়ল, কার এতবড় সাহস।
আঁটির দিকে তাকিয়ে ন্যাদা লাফিয়ে ওঠে। মশা দুটো আঁটির গায়ে মরে লেপটে আছে। ডিলা দি গ্র্যান্ডি, জব্বর বউনি হয়েছে। ন্যাদা চটপট মশাদুটোকে আঁটি থেকে সযত্নে তুলে, একটা চকচকে পলিথিন প্যাকেটে চালান করে দেয়। লোকটা তাহলে তো ঠিকই লিখেছে- ধরো আর মারো, সিওর শট। তাহলে মশক নিধন অভিযানে ন্যাদা এই পথেই চলবে। গ্রামের ছেলেরা আজ যেদিকে ‘রেড’ করেছে ওদিকে নয়। ন্যাদা চলল উল্টোদিকে, সঙ্গে চকচকে পলিথিন প্যাকেট। মশা মেরে রাখতে তো হবে।
মেঠোপথ, দু’ধারে গাছগাছালি ছায়া। ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়া, তার ওপর ভরপেট খাওয়া। ন্যাদা একটা বড় বটগাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে। আজ অনেক হাঁটা হয়েছে। ন্যাদা হাই তোলে। সবে ঘুম ঘুম মুডটা এসেছে, হঠাৎ জেট প্লেনের মতো বোঁ বোঁ শব্দের গুঞ্জনে, ন্যাদার ঘুমের মুড হোঁচট খায়। চোখ খুলে যা দেখল,

তাতে আক্কেল গুড়ুম হবার জোগাড়। চারিদিকে ভিন ভিন করছে মশা। রক্তের গন্ধ পেয়ে আফ্রিকান জংলিদের মতো তাকে ঘিরে উন্মত্ত উল্লাসে, উল্লম্ফ নৃত্য জুড়ে দিয়েছে।- তোদের নাচের নিকুচি করেছে। ন্যাদা ঝড়ের বেগে এলোপাতাড়ি চড়-চাপড় চালাতে থাকে। মুহূর্তে মশারা বুঝে নিয়েছে,- এ বড় শক্ত ঠাঁই, হাতে পড়লে নিস্তার নাই। অতএব যঃ পলায়তি স জীবতি। দেখতে দেখতে সব মশা ভ্যানিশ। কিন্তু তার আগে ন্যাদার হাতে ডজন দেড়েক মশক সৈনিক সাবাড়। ন্যাদা মশাদের মৃতদেহ গুনে গুনে প্যাকেটে ভরে- কুড়িটা হল। পড়তা ভালোই চলছে। ন্যাদা খুশি মনে উঠে পড়ে।
একটু এগুতেই দেখে, একটা বড় পুকুরে দুজন বসে মাছ ধরছে। পেছন থেকে মুখ না দেখা গেলেও ন্যাদা বুঝতে পারে একজন প্রবীণ- মাথায় টাক, হাতে ছিপ। অন্যজন কিশোর। দুজনেরই স্থির লক্ষ্য পুকুরে ফাৎনার দিকে। ন্যাদা পেছন থেকে সাবধানে এগোয়, যা ভেবেছে তাই। ভদ্রলোকের টাকে তিনটে, আর ছেলেটার হাতের খোলা জায়গায় দুটো মশা রক্ত খেয়ে কালো কুঁদো হয়ে বসে আছে। শিকারি বাঘের মতো কুইক অ্যাকশনে, ন্যাদা প্রথম চড় ঝাড়ে ছেলেটির হাতে, আর চকিতে দ্বিতীয় চড় ভদ্রলোকের টাকে। চড়ের চোটে কিশোরটি চমকে আর্তনাদ করে ওঠে। আর ভদ্রলোকের মুখ দিয়ে শুধু ওঁক করে একটা কিম্ভূত আওয়াজ ছিটকে বেরোয়। চোখের চশমা খুলে একটা কান ধরে নাকের পাশে ঝুলতে থাকে। হাতের ছিপ ছিটকে পড়েছে। ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে ন্যাদা চমকে ওঠে। সর্বনাশ!! এ যে এখানকার স্কুলের হেডমাস্টার,রতন স্যার। রতন স্যার হতভম্ব মুখে ন্যাদার মুখের দিকে তাকান।– হ্যাঁরে ন্যাদা, তুই আমায় মারলি?
না, না, স্যার। বিশ্বাস করুন, আপনাদের নয়, মশাদের। এই দেখুন- ন্যাদা রতন স্যারের টাক আর কিশোরের হাতে চেপটে যাওয়া মশাগুলো তুলে নিয়ে দেখায়। এই মশাগুলো আপনাদের ফিনিশ করার ধান্দা করছিল। তাই আমি এদের ফিনিশ করে দিয়েছি।
তা তো ঠিক করেছিস। বলতে গেলে তুই আমাদের বাঁচালি।
এর মধ্যে পঁচিশটা। ন্যাদা বীরদর্পে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের পুলিশ চৌকির কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। একজন হাবিলদার আর দুজন পুলিশ কনস্টেবল থাকে এ চৌকিতে। হাবিলদারকে সে আগেও দেখেছে। ছ’ফুট চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, ইয়া দশাসই চেহারা, আর তেমনি বিশাল জাঁদরেল গোঁফ। অফিসের বারান্দায়, চেয়ারে বসে মৌজ করে গোঁফে তা দিতে দেখেছে কতদিন। কিন্তু আজ কী ব্যাপার? কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। ন্যাদা সাহসে ভর করে এগোয়। নাঃ কনেস্টবলেরা কেউ নেই। হাবিলদার সাহেবের চেম্বারের দরজাও খোলা হাট। ঘরের ভেতর থেকে শুধু ঘোঁক ঘরঘর ঘচাৎ করে বারবার এক অদ্ভুত শব্দ আসছে। খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি দিতেই ন্যাদার চোখ ট্যারা হয়ে যায়। হাবিলদার সাহেব তাঁর বিশাল গোঁফে মুখমণ্ডল সাজিয়ে নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে, গভীর নিদ্রায় মগ্ন। তাঁর গন্ডারের মত খাড়া নাকে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, ঐ বিশাল গোঁফের পাঁচিলে হোঁচট খেতে খেতে ঢুকছে-বেরুচ্ছে। আর আওয়াজ হচ্ছে, ঘোঁক ঘরঘর ঘচাৎ। আর কটা বড় ডাঁশ মশা, গোঁফের দেওয়াল টপকে ঐ খাড়া নাককে টার্গেট করে কামড়াবার চেষ্টা করছে। কিন্তু নাকের প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়ায় বারবার ছিটকে পড়ছে।
মশাদের দেখেই ন্যাদার হাত নিশপিশ করে ওঠে। জুত মতো একটা পজিশন নিয়ে ন্যাদা চকিত তীব্র আক্রমণ হানে। পরপর দু’বার ভীম চপেটাঘাতের তীক্ষ্ম কান -ফাটানো শব্দে মশক নিধন পর্ব খতম হতেই হাবিলদার সাহেব ঘুম থেকে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠেন- কে, কে গুলি ছুঁড়ল? অ্যারেস্ট,অ্যারেস্ট-পাকড়াও,পাকড়াও। চকিতে নিজের কোমরের পিস্তলে হাত দিয়ে ন্যাদাকে দেখে চোখ পাকিয়ে বলেন, তুই, তুই কে? হাবিলদারের গর্জনে ন্যাদা কেঁপে ওঠে। তোতলিয়ে বলে, ন্যাদ্, ন্যাদ্… ন্যাদা স্যার।
ন্যাদা, ভ্যাদা যাই হোস, এখানে কী করছিস, অ্যাঁ? দেখছি শ্রীঘরে যাবার ইচ্ছে হয়েছে। হাবিলদার দু’হাতে তাঁর জাঁদরেল গোঁফ চুমরিয়ে কটমট করে ন্যাদার দিকে তাকালেন। ন্যাদা মরিয়া হয়ে সাহস সঞ্চয় করে তার দু’হাতের চেটো মেলে ধরে। হাতের চেটোতে বড় বড় মশা মরে আটকে আছে।
ওগুলো কী? হাবিলদার ফের গর্জন করে ওঠেন।
মশা স্যার। আপনাকে ডিস্টার্ব করছিল। আমি সাবাড় করে দিয়েছি। দেশের- দশের জন্য নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে, বিপন্ন করে আপনারা কত কী করছেন।। আর আপনার জন্য আমি এটুকু করতে পারব না?
হুম।। তুই তো দেখছি রিয়েলি গুড বয়। থাকিস কোথায়?
চুঁচড়োয় স্যার। এখানে মাসির বাড়ি এসেছি।
হুম্। তোর বডি তো দেখছি বেশ ভালোই। পুলিশে চাকরি করবি?
ন্যাদা জেগে আছে না ঘুমিয়ে? নিজের গায়েই চিমটি কেটে নিজেই লাফিয়ে ওঠে। হাবিলদার গম্ভীর মুখে বলেন, যদি করিস সামনের রোববার সকাল দশটা নাগাদ এস.পি. সাহেবের অফিসে চলে আয়।
ন্যাদা তার নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। ঝপ করে হাবিলদার সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে একটা প্রণাম করে ফেলে। হুঁ। ভব্যতা জ্ঞানও আছে দেখছি। গুড,দ্যাটস্ গুড। তাহলে টাইম মতো চলে আসিস, দেরি করিস না। এরপর ন্যাদা যদি ঝড়ের গতিতে, মাসির খাটের তলা থেকে বাছা বাছা দু’বড় ব্যাগ ভর্তি আমঝেড়ে হাবিলদার সাহেবের চেম্বারে পৌঁছে দেয়, তাতে দোষ আছে কী? হাবিলদার সাহেবের কাছে আমপর্ব সেরে ন্যাদা আবার মশাপর্ব নিয়ে পড়ে। এর মধ্যেই ত্রিশটা হয়েছে -এখনো সত্তরটা। তবে যেভাবে কাজ এগুচ্ছে, তিন- চার দিনেই টার্গেটে পৌঁছে যাবে।
তিনদিন বাদে, রাতে খেতে বসতেই

মাসি ন্যাদাকে ধরেন।- একটু আগে কীসব বিড়বিড় করে বকছিলি? ধরো আর মারো, আটানব্বুইটা খতম। আমি তো ভয়ে কেঁপে মরছি। হ্যাঁরে কাউকে খুন-টুন করিসনি তো? খাওয়া আর শোওয়া ছাড়া, তোর টিকিও তো দেখা যাচ্ছে না।
দেখবে কী করে! ন্যাদা এবার কায়দা করে হাসে। যুদ্ধ চলছে যে, টি ভি তে শোনোনি?
ন্যাদার কথায় ক্ষেমঙ্করী গালে হাত দেন। যুদ্ধ? কোথায়- কার সঙ্গে?
মশাদের সঙ্গে মাসি। মশাদের সঙ্গে।
ওঃ, তাই বল, মশা।।
মাসি ন্যাদা আর মেসোর জন্য থালায় ভাত- তরকারি- ভাজা সাজিয়ে ওদের সামনে নামিয়ে বাঁহাতে ডালভর্তি ডেচকি ধরে- ডান হাতে হাতায় করে মেসোর পাতে ডাল দিচ্ছেন, হঠাৎ ন্যাদার স্বপ্নভঙ্গ হয়। বলে, মাসি তোমাকে, মেসোকে মশা কামড়ায় না?
কামড়াবে না কেন, কামড়ায়। তবে মারতে পারি না। এমন জায়গায় কামড়ায় হাতই পৌঁছায় না।
শোনো মাসি, এবার যখন কামড়াবে, আমি থাকলে আমাকে ডেকো। ধরো আর মারো, কাকে বলে দেখবে।
মেসোর পাতে ডাল দিয়ে মাসি এবার ন্যাদার পাতে হাতায় করে ডাল দিচ্ছিলেন। হঠাৎ ডাল দেওয়া বন্ধ করে, হাতাসুদ্ধু ডান হাতটা সাবধানে তুলে ন্যাদাকে ইঙ্গিত করেন, কামড়াচ্ছে, এই হাতে, কনুইতে।
ন্যাদা গলা বাড়িয়ে উঁকি মারে। মাসির ফর্সা কনুইতে ইয়া বড় মশা। ন্যাদা তড়িৎ গতিতে উঠে, তার আর মেসোর পাতের মাঝে, মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে, তার অভিজ্ঞ হাতের চড় ঝাড়ে মাসির ডান হাতের কনুই লক্ষ করে।
মুহূর্তে ঘরে যেন প্রলয় ঘটে যায়। চড়ের চোটি মাসির ডান হাতে ধরা হাতা, সোজা উড়ে ঘুরন্ত সিলিং ফ্যানে ঠং ঠনাত্ ঠং করে ধাক্কা খেয়ে, রিটার্ন জার্নিতে সবেগে এসে পরে মেসোর ঠ্যাংয়ে।- ওরে বাবারে, মরে গেছি, মরে গেছি বলে মেসো তড়াং করে নিজের আসন থেকে উঠে, ধপ্ করে বসে পড়েন তাঁর ডাল-তরকারি দেওয়া ভাতের থালার ওপর। ব্যাঙের মতো থেবড়ে বসে মেসো যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকেন।
মেসোর আচমকা গুঁতোয়, মাসির বাঁ- হাতে ধরা ডালের ডেকচি থেকে ডাল চলকে ছিটিয়ে পড়ে মাসির সারা কাপড়- ব্লাউজ আর মুখে- চোখে। মাসিকে এখন দেখলে মনে হবে দুরন্ত এক্সপ্রেসের প্রিন্টেড বগি। আর ঐ দুরন্ত ধাক্কায় মাসির হাতের ডালভর্তি ডেকচি, সোজা ন্যাদার মাথায় উপুড় হয়ে পড়ে। সে এক বিতিকিচ্ছিরি কান্ড!
মাসি হাহাকার করে ওঠেন, গেল গেল, সব গেল। ওরে ন্যাদা, তুই একি সব্বোনাশ করলি! ন্যাদা ডালের ডেকচিটা ঝটপ্ট মাথা থেকে তুলে মাসির আঁচলেই মুখটা মুছে কনুই থেকে মরা মশাটা নিয়ে দেখায়, দ্যাখো ফিনিশড। একেই বলে ধরো আর মারো- বুঝলে?
নিকুচি করেছে তোর ধরো আর মারোর। মেসোর আর আমার কী হাল করেছিস, দ্যাখ! তুই ছাগল না পাগল?
যাঃ।। কী যে বল। ন্যাদা লজ্জা লজ্জা মুখে বলে, তুমি আমার মাসি। আমি কি ছাগল হতে পারি? তবে হ্যাঁ, পাগল বলতে পার আমায়,- খুশিতে পাগল, মশার জন্যে পাগল।
কিন্তু হঠাৎ হলটা কী? পরপর তিনদিন সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত সারা গ্রাম চষে একটা মশাও জুটল না। একী অসম্ভব ব্যাপার! তবে কি স্বেচ্ছাসেবকরা সব মশা মেরে ফেলেছে? ন্যাদার কান্না পায়। তাহলে ঐ একশো টাকা পুরস্কার সে পাবে না? ন্যাদার মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। আর থাকতে না পেরে চারদিনের দিন সকালে ব্যাজার মুখে, ছলছল চোখে, দুরু দুরু বুকে পঞ্চায়েত প্রধানের ঘরে ঢুকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। প্রধান পাঁচকরি হালদার কাগজপত্র দেখতে ব্যস্ত। মুখ তুলে ন্যাদাকে দেখে একগাল হেসে বলেন, আরে তুই? কী খবর?
মশা এনেছি স্যার। ন্যাদা মশাভর্তি প্যাকেটটা তুলে দেখায়।
কটা এনেছিস?
নিরানব্বইটা স্যার। একটা কম।
একটা কম? হবে না, হবে না। কম করে একশো। এরপর যা এক্সট্রা, এক টাকা পার পিস। নিয়ে যা- একশোটা হলে, তবে আসিস।
দেখুন না স্যার। মাত্র একটা কম। এর জন্যে ফেরত দিচ্ছেন? একটু কনসিডার করবেন না?
দ্যাখ ন্যাদা, আইন ইজ আইন। তোর জন্যে নিয়ম বদলাতে পারব না। এখন যা, বিরক্ত করিস না।
পাঁচকড়ির দিকে তাকিয়ে ন্যাদার দু’চোখ জ্বলে ওঠে। এক পা, এক পা করে পাঁচকড়ির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। ন্যাদার চোখেমুখে এখন এক হিংস্র জিঘাংসা। ন্যাদার এই মূর্তি দেখে পাঁচকড়ি ভয়ে আঁতকে ওঠেন। উঠে পালাবেন, সে ক্ষমতাও নেই। দু’পা কাঁপছে। হাঁটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি শুরু হয়ে গেছে। চেয়ারে বসেই তিনি তোতলাতে থাকেন, কী-কী-কীরে? তু- তু –তুই, আ-আমায়, মা- মা- মারবি না- নাকি?-অ্যাঁ?
পাঁচকড়ির মুখের কথা মুখেই থেকে যায়। ধাঁ করে এক বিশাল চড় তাঁর গালে এসে পড়ে। এক চড়েই পাঁচকরি দু’চোখে অন্ধকার দ্যাখেন। চেয়ার থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকেন, ওরে বাবারে, মেরে ফেলল, মেরে ফেলল রে!! বাঁচাও, বাঁচাও- খুনি, গুন্ডা, ডাকাত।
পাঁচকড়ির কাতর আর্তনাদে আশপাশের সবাই ছুটে আসে। কিন্তু ন্যাদার মাশল মার্কা চেহারা দেখে কেউই এগোতে সাহস করে না। কিন্তু ন্যাদার কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। নিজেই সযত্নে পাঁচকড়িকে তুলে বসায়। ওর দু’চোখে এখন খুশির ঝিলিক। পাঁচকড়ির গাল থেকে মশার মরা চ্যাপ্টা দেহটা তুলে প্যাকেটে ভরতে ভরতে বলে, সরি স্যার!! এবার গুনে নিন, একশোটা।

– অপর্ণা মুখোপাধ্যায়

[:]