[:bn]নতুন চোখে দেখা[:]

[:bn]নতুন চোখে দেখা[:]

July 1, 2018

[:bn]পরমা ভৌমিক

দুধের ডেকচিটা থাকল বৌদি-কাল ধোব… বলেই দরজার দিকে এগোয় টুম্পা।
“আরে ঘর ও তো ঝাঁট দিলি না!” -বলতে বলতে পেছনে ছোটে শান্তা-সবে টিভিটা চালিয়ে বসেছিল একটু, উফ শান্তি নেই সংসারে! যেই একটু অন্যমনস্ক হয়েছে, অমনি-
“ছিড়িয়াল টা শুরু হয়ে যাবে গো বৌদী”-পায়ে চটি গলাতে গলাতে বলে টুম্পা।
“আরে দাঁড়া দাঁড়া, রোজ তো এখানেই দেখিস,আজ হলটা কি!”-
টঙে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে গদগদ মুখে টুম্পা বলে-“না গো,মোড়ের বৌদিরা লতুণ টি. বি কিনেছে না-ওতে ডেখবো। বড় টি. বি. গো -যা দারুণ পিচকার, ২৪ ইঞ্চি, জানো না!”-চোখ বড় বড় করে এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই দৌড় লাগায় টুম্পা-”কাল থেকে একটু আগে আসবোখন”- যেতে যেতে দয়া করে বলে যায় পিছনে দাঁড়ানো হতভম্ব শান্তার দিকে না তাকিয়েই।
ঘরে এসে ফুল স্পিডে পাখাটা চালিয়ে বসে শান্তা – উফ পাখায় কী হবে,গা-টা রিরি করে জলছে মনে হচ্ছে।হু ২৪ ইঞ্চি-যেন কত বুঝিস ইঞ্ছির হিসাব-সেই ওরাই আগে বড় টিভিটা কিনে ফেলল। কত দিন ধরে বলছে শান্তা অজয়কে, খালি এ-মাসে না-ও- মাসে করে করে -এখন হল তো! সেই শিখারাই মানে টূম্পার মোড়ের বৌদি আগে কিনে নিল, আর শান্তাদের এখনও এই মান্ধাতার আমলের ২১ইঞ্চির…ধুত্তোর, রাগে টিভি অফ করে উঠে পরে শান্তা।
এই সময় সিরিয়ালটা দেকে টূম্পাও চলে যায়, আর শান্তাও গড়িয়ে নেয় একটু, তারপরে তো রুমকি-ঝুমকি স্কুল থেকে এলেই পরপর আবার শুরু- ওদের খাওয়া, পড়তে পাঠানো, শাশুড়ির ছানা, চা, বর ফিরে কি খাবে তার ব্যবস্থা- উফ আজ আর শুয়েও সাধের ছোট্ট আবুলিটা ধরছিল না চোখে- এবার তো ওই শিখার পা-ই পড়বে না মাটিতে। এমনিতেই দেখতে ভালো বলে দেমাকে মটমট- তার ওপর আবার…কী যে এমন দেখতে বোঝে না শান্তা, তার চেয়ে একটু ফর্সা আর ইঞ্চি কয়েক বেশি লম্বা বই তো আর কিছু না! তাতেই-এই তো গত বুধবার না মঙ্গলবার, গড়িয়াহাটের ফুটপাতে চাদর দর করছিল শান্তা, তখন দেখা-
”এগুলো কুলোবে গো খাটে?” -জিঙ্গেস করছিল শিখা।
“হ্যাঁ হ্যাঁ ৫x৭ মাপের তো, খুব টেকে জানো” বলতেই-
“না গো আমার তো আবার ৬x৭ খাট”-

ওমনি ওর খাটের মাপ শান্তার চেয়ে বেড়ে গেল!  দেখতে পারে না দুচোখে শান্তা –

আসলে টাকার গরম আর কি! উপরি পায় তো বরটা- আর শান্তার কপালে এই সাদাসিধে অজয়। আরে, একটু ধান্দাবাজি না করলে এই দুনিয়ায় চলে নাকি! আবার নাকি ফ্ল্যাটও  কিনছে, যদিও সেকেন্ডহ্যান্ড,  তবু ভাড়াবাড়ি

ছাড়বে- তাদের মতো পড়ে তো থাকবে না এই শরিকি বাড়িতে।

“অ বৌমা, শুনছ-”

ওই হল, আবার কী কাণ্ড ঘটিয়েছে বুড়ি দ্যাখো!  বাঁদি তো রেডিই আছে – গজগজ করতে করতে শাশুড়ির ঘরের দিকে এগোয় শান্তা।

ভেবেই রেখেছিল রাতে কথাটা পাড়বে,মেয়েরা ঘুমোতেই অজয়ের দিকে ঘেঁষে আসে শান্তা- এই একই খাটে ওরা চারজন শোয়, মেয়েরা বড় হচ্ছে, এখণ একটা আলাদা ঘর লাগে, কিন্তু নব্বই এর ঘরে শাশুড়ি, তাঁর জন্যেই তোএকটা ঘর বরাদ্দ, ওই ঘরে আরেকটা খাট আছে অবশ্য, কিন্তু রুমকিরা রাতে শুতে চায় না ও ঘরে- অগত্যা এ ঘরেই বেঞ্চি জুড়ে কাজ চলছে। মাঝে মাঝে ননদ বেড়াতে এলে এই ঘর ছেড়ে শান্তা মেয়েদের নিয়ে শাশুড়ির ঘরে আশ্রয় নেয়, আর অজয় ডাইনিঙের মেঝেতে- এভাবেই চলছে দিনের পর দিন।

“কী গো, অফিসের খবর- টবর কী তোমার?”

আলতো করে বরকে ছুঁয়ে ভূমিকা শুরু করে শান্তা-

“ঊ…হুম  হ্যাঁ… ভালোই”-জড়ানো গলায় বলে অজয়।

“উফ এর মধ্যেই ঘুম এসে গেল তোমার!” বিরক্ত হয় শান্তা।

“সকাল  ৮ টা ২০-র লোকালে গাদাগাদি করতে হবে ভাবো, তোমারো আসবে”- পিছন ফিরেই বলে অজয়।

“শোনো না গো”,- বিরক্তি চেপে যথাসম্ভব মোলায়েম করে বলে  শান্তা – কাজ হয়।

“বল ম্যাডাম”- পাশ ফিরে তাকায় অজয়।

“ জানো তো, ওরা চব্বিশ ইঞ্চি টিভি কিনেছে গো!” আবার পাশ ফেরার সুযোগ না দিয়ে অজয়ের হাতটাই বালিশ করে নিয়ে কাছে ঘেঁষে বলে শান্তা।

“ওরা মানে?”’ ভুরু কুঁচকে বলেই বুঝতে পারে -“ওহো  সজলরা, মানে তোমার বান্ধবী, তা ভালোই তো-

“চুপ করো তো, ভালোর আবার কী দেখলে!” – বলে ইচ্ছে  করেই একটু খোঁচায় শান্তা-“তোমারও তো বন্ধু বাপু, দেখো কত কী করছে। ফ্ল্যাটও…”

“উফ্ শান্তা পারোও তুমি, এই রাত দুপুরে!”

” রাত দুপুর না হলে তোমায় পাব কোথায় শুনি? অফিস থেকে ফিরেই তো মায়ের ঘরে, তারপর টিভি-“  গলাটা চড়ে যাছে বুঝতে পেরে সামলে নেয় শান্তা, আবার মিহি করে বলে – “কেনো না গো একটা বড় টিভি, কয়েকমাস না হয় একটু কষ্ট করে… ওরাই বা কী এমন বড়লোক বল, তাও তো…”

“শান্তা, সজলের ঝাড়া হাত-পা”-ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে অজয়-“ দুই ছেলে, বুড়ো মা-বাবার দায় নেই, বোন নেই- আর আমাদের- তুমি তো জানোই সবটা”-

জানে, সব জানে শান্তা, রাণুর বিয়েতেই তো জমানো টাকার প্রায় সবটা বেরিয়ে গেল, তারপর মায়ের তো লেগেই আছে অসুখ-বিসু্‌খ, মেয়েদের পড়া,একটা জমি কেনারই ইচ্ছে আছে- সবই বোঝে, তবু নিজের অজান্তেই দু চোখ ভিজে ওঠে শান্তার, শিখার কাছে হারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে! অন্ধকারেও কান্নাটা বুঝতে পারে অজয়- শান্তার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে-“ দেখব চেষ্টা করে শানু, সেকেন্ড হ্যান্ড ও যদি… হবে তো?” মাথা নেড়ে অজয়কে জড়িয়ে ধরে শান্তা।

পরদিন থেকে আবার স্বাভাবিক নিয়মেই চলতে থাকে সব-যা হয় আর কী-মনের জ্বালাটা অবশ্য ছাই চাপা আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকে শান্তার। মাস দুয়েক পরে শিখারাও চলে যায় নতুন ফ্ল্যাটে, বেশ ধুমধাম করে গৃহপ্রবেশও করেছে। এসে বলে গেছিল বর- বউ ঘটা করে- শরীর ভালো না, শাশুড়ি- এসব আগেই গেয়ে রেখেছিল শান্তা, বাধ্য হয়ে অজয়ই দুই মেয়ে নিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করে এসেছিল।

“ইস যাওয়া হল না, বল তুমি বুঝিয়ে

বুঝিয়ে, পরে যাবো একদিন…” শান্তা সত্যিটা অজয় কে বলতে পারেনি, ইচ্ছে করেই যায়নি ও, উঃ কে যাবে ওই গুমোর দেখতে, ডাঁটে মরবে আর ঘুরে ঘুরে দেখাবো সব নতুন নতুন জিনিস- না সহ্য হবে না শান্তার। তবে যাবে একদিন, নিজের মনেই পণ করেছে শান্তা, যেদিন ওরও বড় টিভিটা আসবে সেদিন, বেশ করে শুনিয়ে আসবে। ছেলে দুটোও কম না। ওর মেয়েরা মাঝে মাঝে টিভি দেখতে গেলে ঠারেঠোরে কথা শোনাত বিচারিদের। এত ছোটতেই… শান্তারও দিন আসবে একদিন, যদি আসে- নয়তো যাবেই না কোনদিন।

দিনটা অবশ্য এসেও যায় মাস ছয়েক পরেই। অফিসে একটা ইনক্রিমেন্ট পেয়ে টিভিটা কিনেই ফেলে অজয়। অবশ্য সেকেন্ড হ্যান্ড, প্রায় নতুনই, চব্বিশ ইঞ্চি তো, তাতেই শান্তি শান্তার-তাছাড়া নতুন ফ্রিজ হয়েছে, ঘর রঙ হবে, অনেক খরচ, টিভি একটু পুরনো তো কি হয়েছে! অজয়েরই এক কলিগের টিভি, সবেই কিনেছিল কিন্তু ট্রান্সফার না কী সব বলছিল অজয়, শোনেওনি ভালো করে শান্তা- গত সপ্তাহে টিভিটা যখন ঘরে ঢুকলো খুশিতে চোখে জল এসে গেছিল শান্তার- নতুন ফ্রিজেও এত আনন্দ হয়নি। আসলে এটা তো শুধু টিভি নয়, ওর কাছে যে কতটা- কে বুঝবে তা! আহ বড় ছবি, ঝকঝকে রঙ! চোখ, মন সব জুড়িয়ে যায় শান্তার- এমনকি টুম্পাও খুশিতে, ডগমগ, ওর মোড়ের বৌদি’র কাজটা চলে যাওয়ায় বড় টিভি দেখা হচ্ছিল না,- নতুন টিভি দেখে তারও পোয়াবারো। আর কোনো সাধ অপূর্ণ নেই তার-না, শুধু একদিন যেতে হবে ওই ডাঁটিয়াল আর মিচকে ছেলে দুটোকে… মনে মনেই কতবার যে রিহার্সাল দেয় শান্তা, কিভাবে কথাটা পাড়বে গিয়ে- তর আর সইছে না ওর, সামনের শনিবারেই যাবে মেয়েরা স্কুল থেকে ফিরলেই!

আজ সকাল থেকেই বেশ একটা চাপা উত্তেজনা হচ্ছিল শান্তার। এই আট মাস শুধু অপেক্ষাই করেছে এই দিনটার জন্যে- আজ যাবে শান্তা, এর মধ্যে খবরাখবরও পায়নি কিছু ওদের। অজয় যেন একদিন কি সব বলছিল ওদের কী যেন প্রবলেম-ট্রবলেম- ভালো করে শোনেনি শান্তা, প্রবৃত্তি হয়নি। আজ যাবার কথা কাউকে বলেনি, অজয়কেও না! এই ক’মাসে আসতে-যেতে কতবারই তো দেখেছে বড়, জ্বলজ্বলে করে ‘দ্বীপ  অ্যাপার্টমেন্ট’ লেখা বাড়িটা, আজ ঢুকবে বুক ফুলিয়ে- কিন্তু প্রসঙ্গটা তুলবে কি করে! টিভির ঘরেই বসালে তো মিটেই গেল- “জানো তো আমরাও 36 ইঞ্চি কিনেছি গো”- বলে শুরু করা যাবে, যদি অন্য ঘরে বসায়, তাহলে!- ভাবতে থাকে শান্তা-

“যাই গো টিভিতে একটা ভালো বই আছে আজকে” -বলেও শুরু করা যায় নয়তো- চড়চড় করে চচ্চড়িটা লেগে যাবার শব্দে সম্বিত ফেরে শান্তার, কড়ায় তাড়াতাড়ি হুড়ুম করে জল ঢেলে দেয় খানিকটা খলেনি ভাগ্যিস!

দরজা খুলেই কেমন যেন অপ্রস্তুত একটা হাসি, তাও কোনওরকমে হেসে শিখা বলল- “আরে এসো এসো, কী ভালো লাগছে…  পর-” এসো কি ভালো লাগছে কতদিন পর-”

মনে মনে ‘ন্যাকা’ বললেও মুখে একগাল হেসে শান্তা বলল-“আরে কতদিন থেকেই তো আসব ভাবছি, আজ বারি রঙ, গ্রিলের মিস্ত্রি- লেগেই আছে একটা না একটা-”

যাক বাড়ি যে রিনোভেট হচ্ছে সেটা শোনানো গেছে- মনে মনে খুশি হয় শান্তা- ওকে বসিয়ে ভিতরে যায় শিখা। ঘরদোর যেন কেমন একটা শ্রীহীন লাগছিল শান্তার, ঠিক মিলছিল না যেমনটা ভেবেছিল-

“নাও ধরো যা গরম এসেছ…” এক গ্লাস দই-এর ঘোল নিয়ে ফিরে এসেছে শিখা। “আরে আবার এসব করতে গেলে কেন”- বলেই তৃপ্তির চুমুক দেয় শান্তা, দিয়েই বলে ফেলে-

“আমিও বানিয়ে রেখে দিই ফ্রিজে, স্কুল থেকে এসেই তো ঠান্ডা চাই সব…”ফ্রিজ হচ্ছে সেটাও বুঝিয়ে দেওয়া গেছে।

এটা-সেটা অনেক কথাই চলতে থাকে। কিন্তু শান্তার মনে অশান্তি-টিভির প্রসঙ্গ আসছে কই। শিখাকেও কেমন যেন লাগছে, মুখে বড় বড় ফুটুনি নেই তো তেমন। রূপও আগের মতো… ছেলেদের খেতে দিতে শিখা ভেতরে যেতেই পায়ে পায়ে শান্তাও যায় ওর পেছনে- “না গো, আর যাই আসলে…” ঘরে ঢুকে থমকে যায় শান্তা, ছেলে দুটো ঝগড়া করছে খাওয়া নিয়ে- শিখা ধমকাচ্ছে চাপা স্বরে-

“চুপচাপ খাও, অর্ধেক ডিম রাতে খাবে বলছি না-” শান্তা ঢুকতেই অপ্রস্তুত মুখে বলে- দেখ না লেগেই আছে রাম-রাবণের যুদ্ধ- তুমি উঠছো।” টিভিটা এই ঘরেই, দেখে নিয়েছে শান্তা, “অ্যাঁ হ্যাঁ, যাই, ওই এখন একটা সিরিয়াল…”

“খূব ভালো লাগল এলে শান্তা- কোনো কাজ ছিল নাকি এদিকে…”-

শিখা বলে যাচ্ছিল নিচু গলায়- “শুনেইছ নিশ্চয়ই অজয়দার কাছে, প্রায় ছ’মাস হল এই বারি আসার পরই… ওর চাক্রিটা… বোঝো তো এই বাজারে ছ’মাস মাইনে নেই…” চোখের কোণে জল চিকচিক করছিল শিখার…

এতদিন ধরে প্র্যাকটিস করা কথাগুলো কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল সব, ভেতর থেকে অন্য কেঊ যেন বলে উঠল-

“কাল দুপুরে টুবাই-বুবাইকে একটু পাঠিয়ে দিও শিখা, মানে এটাই বলতে এসেছিলাম, মানে এমনি অনেক দিন একসঙ্গে মেরে ফেলে না ওরা তাই…”

মনের জ্বালাটা আর টের পাচ্ছিল না, তবে চোখটা কেমন যেন জ্বালা জ্বালা করছিল শান্তার। বাড়ির আগের স্টপেজেই নেমে পড়ল, একটু বাজার করে বাড়ি যাবে। একটু মুরগি আর দেশি হাঁসের ডিম কিনবে কাল – ওদের জন্য মাংস আর ডিম, হ্যাঁ গোটা গোটা ডিমের ঝোল রান্না করবে শান্তা।

ছবিঃ সুবল সরকার

[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Contact Us

(033) 23504294

rajika.mazumdar@gmail.com

21, Jhamapukur Lane, Kolkata - 700 009.

Book Shop

View All