[:bn]মামা ভাগ্নে সংবাদ[:]

[:bn]মামা ভাগ্নে সংবাদ[:]

October 6, 2018

[:bn]হঠাৎ কলিংবেল বাজতেই অবাক্ হলেন বিপিনবাবু। এখনও কাউকে ঠিকানা জানান নি। কাজেই তাঁকে সাত সকালে খুঁজতে কে আসতে পারে? তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন বিপিনবাবু। বাইরে বেরিয়ে এসেই দেখলেন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে একটি লোক। তার এক হাতে বিরাট একটি মিষ্টির ঝুরি।
কি ব্যাপার! বিপিনবাবু মিষ্টির দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য ভাবলেন। তারপর লোকটিকে চিনতে চেষ্টা করলেন প্রাণপণ। না, কিছুতেই পারলেন না চিনতে।
তাঁর জন্যেই কি লোকটি অমনি মিষ্টির ঝুড়িটা নিয়ে এসেছে? যদি সত্যিই তাঁর জন্য নিয়ে আসে? খুশীতে কাঁটা দিয়ে উঠল বিপিনবাবুর সমস্ত শরীরে।
‘কাকে চাই?’বিপিনবাবু অসম্ভব চেনা চেনা গলায় শুধালেন লোকটিকে।
‘বিপিনবাবুকে।’লোকটি একমুখ হাসলো অকারণেই।

‘আমিই বিপিনবাবু। গতকাল সন্ধ্যেবেলায় এসেছি এ বাড়িতে।’ সোৎসাহে বিপিনবাবু বলে উঠলেন।
এবার লোকটি মিষ্টির ঝুড়িটা এগিয়ে ধরলো বিপিনবাবুর দিকে। বললে,‘শ্যামসুন্দরবাবু পাঠিয়ে দিয়েছেন এই ঝুড়িটা-’
‘কে শ্যামসুন্দরবাবু? কেবল সুন্দরবাবু বলে একজনকে চিনি। মানে, তিনি আমার বন্ধু। কিন্তু শ্যামসুন্দর বলে তো কাউকে চিনি না।’ কেমন একটু যেন নিরুৎসাহ বোধ করলেন বিপিনবাবু।
লোকটি বললে, ‘ঠিক মোড়ের মাথায় সব চাইতে বড় মিষ্টির দোকানটার নাম ‘জয়তারা মিষ্টান্ন ভান্ডার।’ আর শ্যামসুন্দরবাবু তার মালিক।’
‘ মানে, হঠাৎ শ্যামসুন্দরবাবু কেন এই মিষ্টি পাঠালেন-’বিপিনবাবু অবাক্ হওয়া গলায় বললেন এবার।
‘সে সব আমি জানি না। তবে এর জন্য আপনাকে দাম দিতে হবে না, তা বলে দিয়েছেন শ্যামসুন্দরবাবু।’
বলে বিপিনবাবুর হাতে মিষ্টির ঝুড়িটা ধরিয়ে দিয়ে লোকটি বললো, ‘চলি।’
বিপিনবাবু খুব সাবধানে লোকটিকে আড়াল করে ঝুড়িটার ওজন দেখতে দেখতে বললেন, ‘আচ্ছা।’
লোকটি হনহন করে বেরিয়ে চলে গেলো।
সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ বেগে ভিতরে চলে এলেন বিপিনবাবু। কি মিষ্টি পাঠিয়েছে দেখতে হচ্ছে আগে।যা ওজন ঝুড়িটার।
মুহূর্তে ঝুড়িটা খুলে ফেললেন বিপিনবাবু।

শুধু রসগোল্লা আর রসগোল্লা। উফ্, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে এতো রসগোল্লা দেখে। তার ওপর আবার দাম দিতে হচ্ছে না।
প্রবল আনন্দে গোটা কয়েক রসগোল্লা পরপর খেয়ে ফেললেন বিপিনবাবু।
এক সপ্তাহ পরে বাড়ির সবাই আসবে এই নতুন বাড়িতে। এই এক সপ্তাহ যদি রোজ সকালবেলা এমনি রসগোল্লা দিয়ে যেতেন শ্যামসুন্দরবাবু।
ভাবতে ভাবতেই বিপিনবাবু আরো গোটা কয়েক রসগোল্লা মুখে পুরে ফেললেন। তারপর এক গ্লাস জল ঢক্ ঢক্ করে খেয়ে আরাম করে বসে ‘আঃ’ করে আরামের একটা শব্দ করলেন।
কিন্তু হঠাৎ এমনিভাবে লোক দিয়ে রসগোল্লা পাঠালেন কেন শ্যামসুন্দরবাবু?
রসগোল্লায় ভরা পেটে ফের গভীরভাবে ভাবতে শুরু করলেন বিপিনবাবু।
ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ পেয়ে গেলেন কারণটা।
নতুন লোক পাড়ায় এলেই বোধহয় শ্যামসুন্দরবাবু এমনি রসগোল্লা পাঠান। একবার রসগোল্লা খাইয়েই গ্রাহক করে রাখেন শ্যামসুন্দরবাবু। গ্রাহক তৈরীর একটা কৌশল হয়তো।
যাকগে, আপাততঃ আর কোন কারণ ভাববার কোন দরকার নেই। সারাদিন ধরে আজ কেবল রসগোল্লাই খাবেন বিপিনবাবু। ভাবতে ভাবতেই উঠে গিয়ে দুটো রসগোল্লা মুখে পুরে ফের এসে বসলেন।
ঠিক তখুনি আবার বেজে উঠলো কলিংবেল।

খুললেন তাড়াতাড়ি। দেখলেন বিনীতভাবে একজন দাঁড়িয়ে।
‘বিপিনবাবু আছেন?’ বিনীতভাবেই শুধালো সে।
বিপিনবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আমিই বিপিনবাবু।’
লোকটি নমস্কার দিয়ে বললো, ‘জয়কালী ডাইংক্লিনিং থেকে আমায় পাঠিয়েছে। এই যে, এই প্যাকেটটা রাখুন।’
রহস্যময় চোখে প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে বিপিনবাবু বললেন, ‘কি আছে এতে?’
‘সে আমি জানি না। আপনাকে দেবার জন্য দিয়ে দিয়েছে আমায়, ব্যস।’
বলে কোন রকমে বিপিনবাবুকে প্যাকেটটা গুছিয়ে দিয়ে মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল লোকটি।
আর বিপিনবাবু প্রবল কৌতুহলে মুহূর্তেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খুলে ফেললেন রহস্যময় প্যাকেটটা।
দুটো ছেঁড়া পাজামা আর দুটো ছেঁড়া পাঞ্জাবি বেরুলো প্যাকেট থেকে। কিন্তু ভারী চমৎকার করে কাচা জামা-কাপড়গুলো।
না, কিছুই ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সমস্ত ব্যাপারটা রহস্যময় হয়ে রইলো।
ভাবতে ভাবতেই গোটা চারেক রসগোল্লা খেয়ে ফেললেন বিপিনবাবু। ফের একটু জল খেলেন। তারপর ছাদের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে ভাবতেই থাকলেন ব্যাপারটা।
আপিসে বেরুবার মুখে আরেক জনের মুখোমুখী হলেন বিপিনবাবু।
‘নমস্কার। আপনিই বুঝি বিপিন গাঙ্গুলী?’ লোকটি আপাদমস্তক বিপিনবাবুকে দেখে নিয়ে বলল।
সঙ্গে সঙ্গে বিপিনবাবু বললেন, ‘আপনিও কিছু নিয়ে এসেছেন নাকি?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। দু’খানা গায়ে মাখবার সাবান আর একটা প্যাকেট ব্লেড।’ বলেই লোকটি হাতের ঝোলা থেকে বের করলো জিনিসগুলো।
হাত বাড়িয়ে জিনিসগুলো নিয়ে নিলেন বিপিনবাবু। তারপর বললেন, ‘কোন্ দোকানটা আপনাদের?’
‘পারিজাত স্টেশনার্স।’
‘ঠিক আছে। আপনি আসতে পারেন এখন।’
লোকটি চলে গেল।
বিপিনবাবু জিনিসগুলো বাড়িতে রেখে ফের বেরিয়ে পড়লেন। কিন্তু আপিসে কোন কাজ করতে পারলেন না। কেবল ভাবতে থাকলেন রহস্যময় ব্যাপারটা নিয়ে। আসবার সময় একবার অবশ্য ভেবেছিলেন সবাইকে জিজ্ঞেস করে নেবেন ব্যাপারটা। কিন্তু নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে না পেরে আর জিজ্ঞেস করেন নি বিপিনবাবু।
বিকেলে আপিস থেকে ফিরলেনও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে। কোথাও বেরুতে পর্যন্ত পারলেন না।
সন্ধ্যে হতে হতেই আরও চারজন এলো জিনিস নিয়ে। কেউ-ই কিছু বললো না। জিনিসগুলো দিয়ে দোকানের নাম বলে চলে গেল।
পাড়াটাই বুঝি চমৎকার। শেষ পর্যন্ত মনে হলো বিপিনবাবুর। ভাগ্য ভালো না হলে বুঝি এমন পাড়ায় আসা যায় না।
পরদিন সকাল থেকেই কিন্তু শুরু হলো অন্য কান্ড। প্রথমেই শ্যামসুন্দ্রবাবু এলেন। বললেন, ‘আপনার মামা খুব ভালো লোক কিন্তু।’
‘আমার মামা ভাল লোক মানে? আমার মামাই নেই।’ অবাক্ হয়ে বললেন বিপিনবাবু।
তেমনি অবাক্ হয়েই শ্যামসুন্দরবাবু বললেন, ‘অঘোরবাবু তাহলে কে?’
‘ অঘোরবাবু মানে ?’
‘ এ বাড়িতে যিনি ছিলেন। আপনার জন্য যে তিন কেজি রসগোল্লা পাঠিয়েছি, তার দামও দিয়ে গেছেন তিনি-’
‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কিচ্ছু।’বিপিনবাবু অসহায়ভাবে বললেন।
শ্যামসুন্দরবাবু বলেই চললেন, ‘এই বিলটা যে আপনি দেবেন, তাও বলে গেছেন আপনার মামা- মানে অঘোরবাবু।’
কথাটা শেষ করেই একটা বিল বের করলেন শ্যামসুন্দরবাবু। একশো সাত টাকা ষাট পয়সার বিল।

‘এই বিলের টাকা আমায় দিতে হবে?’ চমকে উঠে ভয়ার্ত গলায় বললেন বিপিনবাবু।
শ্যামসুন্দরবাবু একটুখানি হেসে বললেন, ‘আজ্ঞে হাজার হলেও তিনি আপনার মামা যখন-’
‘আমার মামা নেই। একেবারেই নেই। অঘোরবাবুর নামও এই প্রথম শুনলাম-’ ফের বলে উঠলেন বিপিনবাবু।
‘তাতে কি আছে। একশো সাত টাকা ষাট পয়সায় যদি একজন মামা পাওয়া যায়, তাহলে লাভই তো। সেই যে কি একটা কথা আছে না, নেই মামার চাইতে কানা মামাও ভালো, অঘোরবাবু কানা নন। চশমা পর্যন্ত পরেন না।’
‘আমি সে সব খবর রাখি না। রাখার দরকারও নেই আমার।’ একটুখানি যেন চটেই উঠলেন বিপিনবাবু।
বিপিনবাবুর চটে ওঠা গ্রাহ্য করলেন না শ্যামসুন্দরবাবু। বললেন, ‘কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই আপনার খবর রাখেন। ভাগ্নে বলে ভালোওবাসেন। না হলে তিন কেজি রসগোল্লা জন্য টাকা দিয়ে যান?’
‘যারা যেচে গেছে মামা হতে চায় তাদের যে কারো খবর রাখা কিচ্ছু কঠিন নয়।’
‘যাকগে, আমার আবার কাজ আছে। বিলটা রেখেই গেলাম। মামার জন্য ভাগ্নের নিশ্চয়ই কিছু করা উচিত। যখন খুশী বিলটা পাঠিয়ে দেবেন। চলি-’
বলে তিনি চলে গেলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ঢুকলেন জয়কালী ড্রাইংক্লিনিং- এর প্রোপ্রাইটর। তাঁর হাতে তেএিশ টাকা পঁচিশ পয়সার বিল। সেটা বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘অঘোরবাবু আপনার কথাই বলে গেছেন। নিন, বিলটা মিটিয়ে দিন- চলে যাই।’
‘কিন্তু অঘোরবাবুকে আমি চিনি না।’ একটু উত্তেজিতভাবেই বললেন বিপিনবাবু।
‘না চিনলে তিনি আপনার কাছে দুটো পাঞ্জাবি আর দুটো পাজামা আমাকে দেবার জন্য বলে যেতে পারেন? কক্ষণো পারেন না। তিরিশ বছরের দোকান আমার। কখনও এমনি দেখিনি।’ গম্ভীরভাবে বললেন জয়কালীর প্রোপ্রাইটর।
‘ও পাজামা-পাঞ্জাবি ফেলে দেয়া জিনিস।’
‘ফেলে দেয়া জিনিস আমি ধুতে নিই না কক্ষণো। তেমন বাজে দোকান নয় আমার। আপনি তো আর আমার দোকান দেখেন নি? দেখলে এমন কথা কখনোই বলতেন না।’চটে উঠে বললেন জয়কালীর প্রোপ্রাইটর।
‘মানে, ঠিক তা বলিনি আমি।’ বিপিনবাবু খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েই বলেন।
‘শুনুন কাল বিকেলে টাকাটা দেবেন। ভারী ঠ্যাকায় পড়ে গেছি। আর আপনার মামার সঙ্গে দেখা হলে বেড়াতে আসতে বলবেন-’
কথাটা শেষ করে বেরিয়ে চলে গেলে জয়কালী ড্রাইংক্লিনিং- এর প্রোপ্রাইটর।
নিরুপায় বিপিনবাবু চোখের সামনে নিয়ে বসেই রইলেন।
এরপরই এক এক করে এলো আর সবাই। কেউ কেউ বিপিনবাবুর মামার অজস্র প্রশংসাও করে গেল। চেহারার সঙ্গে মিলও বের করে গেল কেউ কেউ।
বিলের টাকার জন্য অবশ্য তেমন তাড়া দিলো না কেউ। পাড়ায় যখন বিপিনবাবু এসেই পড়েছেন, পালাতে তো আর পারবেন না জিনিসপত্র সব ফেলে। সুতরাং বিল রেখে যেতে আর আপত্তি কিসের?
সবাই চলে যাবার পর বিলগুলো নিয়ে বসলেন বিপিনবাবু। তারপর খাতা-পেন্সিল বের করে হিসেব করে ফেললেন- তিনশো দু’টাকা সাতাশ পয়সা হল মোট।
দিতেই হবে টাকাটা। অঘোরবাবু যে তাঁর মামা নন, কেউ তা বিশ্বাস করেনি। করবেই বা কেন? যে মামা রসগোল্লা পাঠায়, পাঞ্জাবি-পাজামা দিয়ে যায়, গায়ে মাখার সাবান আর ব্লেড পাঠায়- সে কখনও এক্কেবারে নিজের মামা না হয়ে পারে?
বিপিনবাবু ব্যাগ খুললেন। তিনশো দু’টাকা সাতাশ পয়সা দিতে পারেন আজই-
না, মামাকে যত তাড়াতাড়ি কাঁধ থেকে নামানো যায় ততই মঙ্গল। আর নামিয়েই এ পাড়া ছাড়তে হবে। এরপর ভাগ্নের জন্য অঘোরবাবু আরও কি কান্ড করে গেছেন কে জানে!
বেরিয়ে পড়লেন বিপিনবাবু। তারপর একে একে সবাইকে টাকা দিয়ে চলে এলেন শ্যামসুন্দরবাবুর কাছে।
টাকাটা বের করতেই শ্যামসুন্দরবাবু বললেন, ‘সেকি, এখুনি টাকাটা দিচ্ছেন যে-’
‘যতো তাড়াতাড়ি মামার ঋণ শোধ করা যায় আর কি।’ বিপিনবাবু বললেন।
‘সত্যিই, আপনার মত ভাগ্নে পাওয়া যায় না। অঘোরবাবুর সঙ্গে দেখা হলে বলবো।’ শ্যামসুন্দরবাবু বললেন।
অসহায়ভাবে হেসে বিপিনবাবু বললেন, ‘তা বলবেন নিশ্চয়ই।’
‘আর আপনার একখানা ছবি চাই আমার। রেখে দেব। ওই তো, দেখুন না,আমার দোকানে সব বড় বড় লোকের ছবি বাঁধিয়ে টাঙানো’- ছবিগুলো দেখালেন শ্যামসুন্দ্রবাবু।
ছবিগুলোর ওপর এক মুহূর্ত চোখ বুলিয়ে নিয়ে বিপিনবাবু বললেন, ‘অঘোরবাবুর সঙ্গে দেখা হলেই চেয়ে নেবেন আমার ছবি। যিনি আমার মামা হয়ে যেতে পারলেন, ছবি দিতেও ঠিক পারবেন তিনি-’
বলেই বিপিনবাবু হনহন করে ফিরতে থাকলেন বাড়ির দিকে।
আর কি-ই বা বলতে পারেন তিনি।

– নির্মলেন্দু গৌতম

[:]