[:bn] কান্তি ক্যাটারার্স[:]

[:bn] কান্তি ক্যাটারার্স[:]

March 23, 2018

[:bn]

বহু পুরনো অশ্বথ্থ গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে চোখে জল এসে গেছিল অমিয়বাবুর। এই গাছ, এই জমি, ছোটবেলার স্মৃতি জড়িয়ে আছে এসব ঘিরে। দূরে দূরে অনেকগুলো শিশু গাছ খুব যত্ন করে লাগিয়েছিলেন তার বাবা।প্রকাণ্ড গাছটার নিচে বসে বাবা কত শীতের দুপুরে মজার মজার গল্প বলেছেন। আর তিনি বাবার বুকের কাছে মাথা ঠেকিয়ে চোখ গোল গোল করে শুনেছেন। অমিয়বাবুর বাবা খুব পরোপকারী মানুষ ছিলেন। কতজনকে যে নিরবে অর্থ সাহায্য করতেন তার ইয়ত্তা নেই।তাই সঞ্চয় তিনিও সেরকম কিছু রেখে যেতে পারেননি। অমিয়বাবুকে ছোটবেলায় বলতেন, ‘শোনো অমু, মানুষের ভালোবাসাই হল জীবনের প্রকৃত সঞ্চয়।’
ছোট্ট একফালি জমি ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন অমিয়বাবু।বিক্রি যখন করতেই হবে, মায়া বাড়িয়ে লাভ কি। মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা নইলে কি করে হবে। তাঁর মেয়ে অরুনিমা পড়াশোনায় ভালো। দেখতেও মন্দ নয়। সবদিক থেকে দেখতে গেলে সুপাত্রীই সে। অরুর বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনের শ্রাবণ মাসে।
বহুকষ্টে অমিয়বাবুর এক দূরসম্পর্কের বোন মারফত এই সম্পর্কটি হয়েছে, তাই যত খরচই হোক তিনি পিছপা হতে রাজি নন।
কিন্তু এতো কিছু করেও তিনি কুলিয়ে উঠতে পারলেন না। একটা জুটমিলে কাজ করতেন অমিয়বাবু হঠাৎ মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক দিন আগেই তাঁর চাকরি গেছে। সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই। তাঁর ভাঁড়ার প্রায় শূন্য এখন। এখনও বিয়ের জোগাড়যন্ত্র, সাজসরঞ্জাম, অতিথি আপ্যায়ন সবকিছুর খরচ বাকি। একমাত্র মেয়ের বিয়ে যেমন তেমন করে তো আর দিতে পারেন না। আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী বলবে কি ? এই ভেবে খুব মুষড়ে পড়লেন মনে মনে। শরীর ভেঙ্গে গিয়েছে। প্রেশার,সুগার দুটোই বেড়েছে। অমিয়বাবুর স্ত্রী একা হাতে এখন আর ততটা পেরে ওঠেন না। অল্প কাজেই হাপিয়ে ওঠেন। দূরের আত্মীয় স্বজন বিভিন্ন ছুতোয় বিয়েতে আসতে পারবে না বলে জানিয়েছে। সবটুকু আয়োজন কি করে হবে এসব ভাবতে ভাবতেই কি করে যেন দিনগুলো পার হয়ে যাচ্ছে।
অশ্বথ্থ গাছটার নিচে বসে এইরকম সাত-পাঁচ ভাবছিলেন। তারপর মনে মনে একটা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন। না খেতে পেয়ে মরে গেলেও পিতৃ-পুরুষের এই জমি কিছুতেই বিক্রি করবেন না। তার বদলে, তার বদলে ….. নিজের আঙুলের মধ্যমার দিকে তাকান অমিয়বাবু। একটা ছোট্ট হীরের আংটি। বেশ পুরোনো, ঠাকুরদার আমলের। এটাই আপাতত বন্ধ রেখে দেবেন।মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকেন তিনি।
হঠাৎ একটা লোকের ডাকে ওনার সম্বিৎ ফেরে। সিড়িঙ্গে মতন লোকটা ওনার বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ওনার স্ত্রীর সঙ্গে কী যেন কথা বলছিল। মিশকালো রঙের ওপর মিশকালো কোর্ট চাপিয়ে লোকটাকে দেখতে দূর থেকে একটা দাঁড়কাকের মতই লাগছিল।অমিয়বাবু সামনে দাঁড়াতেই বলে ওঠে, ‘ আজ্ঞে আমার নাম নিশিকান্ত সাহা। আমি কান্তি ক্যাটারার্স -এর মালিক।শুনলাম আপনার মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের সার্ভিস কিন্তু খুব ভালো। একদম ফুল প্যাকেজ। আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না।ঘরবাড়ি বারান্দা সাজানো থেকে খাওয়া-দাওয়া সব কিছু খেয়াল আমরা রাখব। আমার ছেলেরা খুব চটপটে। নিমেষের মধ্যে সব কাজ সেরে ফেলে।
অমিয়বাবু বললেন, ‘তা তো বুঝলাম কিন্তু, এত খরচ করার সামর্থ্য আমার নেই ।একটু কমের মধ্যে যদি হয়।’
টাকা-পয়সার হিসাব পরে হবে। যদি কাজ পছন্দ হয় তবেই । আপনার বাবা, আমার বাবাকে কাজ দিয়েছিলেন। আপনার হয়তো মনে পড়বে না। আপনি তখন খুব ছোট। আমার বাবা শশীকান্ত আপনার অন্নপ্রাশনের দায়িত্বে ছিলেন।
অমিয়বাবু যেন ছোটবেলার দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছিলেন। ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, তা হবে, তা হবে। কিন্তু তখন বোধহয় অন্য কিছু নাম ছিল, তাই না ?
নিশিকান্ত হেসে বলল, ‘তখনকার দিনে আর ওসব কোথায় স্যার ? ছেলেদের দল কোমরে গামছা বেঁধে, বালতি নাচিয়ে ঝোল-ঝাল-ডাল- ছ্যাঁচড়া পরিবেশন করত।
‘ ঠিক বলেছ’ !
আবার অমিয়বাবু স্মৃতিচারণ করলেন। ‘আহা’ ছ্যাঁচড়া নামের বস্তুটি অমৃত ছিল।’
আমাদের কাছে একদম অথেন্টিক বেঙ্গলি কুইসিন পাবেন। ছ্যাঁচড়া তো আমাদের স্পেশালিটি।’
অমিয়বাবু আর দ্বিমত করলেন না।
অবশেষে নির্দিষ্ট দিন প্রায় উপস্থিত। কিন্তু নিশিকান্ত সাহার পাত্তা নেই কোনো। কোনো ফোন নম্বর নেওয়ার কথা মাথায় আসেনি অমিয়বাবুর।
তাঁর গিন্নি গজগজ করতে থাকেন, ‘তুমি কি গো ! ! এত আপনভোলা হলে আজকালকার দিনে চলে? আর মাত্র একটা দিন বাকি আছে বিয়ের।
হঠাৎ কোথা থেকে নিশিকান্ত এসে হাজির। হাতজোড় করে বলল, ‘কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। আমার লোকজন সব কাজ সেরে রাখবে। বাবার হুকুম আপনাদের যেন কোনরকম অসুবিধে না হয়।’
পরের দিন সকালবেলা ঘুম ভেঙ্গে উঠে কর্তা-গিন্নির তো চক্ষুস্থির। সুন্দর করে নানা রংয়ের ফুল দিয়ে ছাদনা তলা সাজানো হয়েছে। উঠোন জুড়ে নানা রঙের আলপনা। রঙিন প্যান্ডেল। নহবত বসানোর ব্যবস্থা। নিশিকান্ত আবার এসে উপস্থিত।
‘কেমন দেখছেন সব?’
‘চমৎকার। কিন্তু এতসব হল কখন?’
‘ আসলে দিনের বেলা অন্য একটা জায়গায় কাজ ধরেছি তো । তাই রাতের বেলা আপনারটা সেরে দিয়ে গেলাম। আপনাকে বলেছিলাম না ? কিছুই টের পাবেন না। আমার লোকজন এত ভাল কাজ করে।’
নিশিকান্ত চলে যেতেই অমিয়বাবুর গিন্নি বলতে থাকেন, ‘আমার বাপু ভয় করছে। এতো কিছু করলো,টের পেলাম না। লোকটা তুকতাক, মন্ত্র-তন্ত্র কিছু জানে না তো।
অমিয়বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোমার সব কিছুতেই সন্দেহ। তুমি তো রোজ এমন নাক ডেকে ঘুমায়, টের পাবে কেমন করে? আমি কাল রাতে ছাদের ওপর ধুপধাপ শব্দ পেয়েছি। তারপর উঠোনে কারা খিলখিল করে হাসছিল। জানালা দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে দেখি, প্রায় জনা পঁচিশেক বউ-ঝিয়েরা উঠোন জুড়ে বসে আছে। নিশিকান্ত মাঝখানে দাঁড়িয়ে সব তদারক করছে। সকালে উঠে ভাবলাম বুঝি সব স্বপ্ন দেখছি। মেয়ের বিয়ের যা টেনশন।’
বিয়ের দিন কম নয়, কমসে কম দেড়শো জন বরযাত্রী এসে উপস্থিত। বরযাত্রীদের মধ্যে নানারকম লোক থাকে। একজন মুরুব্বী ,জ্যাঠা -কাকা সম্পর্কের, তাঁর কাজ সব ঠিকঠাক ব্যবস্থা হয়েছে কিনা দেখা।
একজন মামি, মাসি,জেঠি থাকেন যিনি সবকিছুতে খুঁত ধরতে ভালোবাসেন। একজন পিসি থাকে যিনি কিনা সারাক্ষন লিপস্টিক আর শাড়ি ঠিক করতে থাকেন। পাত্রের এক মামা থাকেন যিনি খেতে খুব ভালোবাসেন এবং কোনবার ১০০ পিস্ রসগোল্লা আর ৪০ পিস্ মাছ খেয়ে ছিলেন সে গল্প কাউকেই শোনাতে বাকি রাখেন না। পাত্রের এক বেদম ফাজিল বন্ধু থাকে যে অদ্ভুত বোকা বোকা জোক শুনিয়ে সবাইকে হাসানোর চেষ্টা করে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
গ্রাম দেশ। বিয়ের লগ্ন রাত একটায়। একটু রাত হতেই বরযাত্রীদের বাস এসে দাঁড়িয়েছে নিঝুম তরলতলায়। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে সানাই -এর আওয়াজ। পাত্রের জেঠু বললেন, ‘কই কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না, কে একজন পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে বলেছিল।’
পাত্রের মাসি বললেন, ‘এইজন্যই তোমাদের পই পই করে বলেছিলাম এঁদো গাঁয়ে বিয়ে দিও না।’পিসি বললেন, ‘এত অন্ধকার আমার লিপস্টিকটাও ঠিকভাবে লাগানো যাচ্ছে না।’ বন্ধু বলল, চাঁদ উঠেছে, ফুল ফুটেছে, কদমতলা ফাঁকা।’
অমনি অন্ধকারের মধ্যে সারি সারি লন্ঠন দেখা গেল।কারা যেন সমস্বরে বলল,এদিকে আসুন, এদিকে।
বরযাত্রীরা লাইন করে সেই সারি সারি লন্ঠনের পিছু পিছু চলতে লাগল। আশ্চর্য ! অন্ধকারে লন্ঠন ছাড়া কিছু দেখা যায় না। লোকগুলোর গায়ের রং এত কালো।
একটু পরেই বাড়িটা দেখা গেল। দোতলা বাড়ি সুন্দর সাজানো। পাশে বাগান। চারিদিকে আলো ঝলমল করছে। কিন্তু লণ্ঠন হাতে লোক গুলো আর নেই। চারপাশে বউ-ঝিয়েরা ভিড় করেছে, সবার মুখেই একহাত ঘোমটা। পাত্রের মামা ইতিমধ্যে খাবার জায়গায়। ‘আগে গেলে চমচম, পড়ে গেলে ভাগে কম’, তিনি এই থিওরির বিশ্বাসী। পাশের মাঠে বিরাট প্যান্ডেল করে খাওয়ার জায়গা। টেবিলেই শুধু সুন্দর আলো। আর চারপাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে বিভিন্ন রকম সুখাদ্যের ট্রে নিয়ে কালো সিড়িঙ্গে লোকজন যাওয়া-আসা করছে। মামাবাবু বহু চেষ্টাতেও তাদের কারও মুখ দেখতে পেলেন না। শুধু টেবিলের ওপর সুন্দর কারুকাজ করা থালায় বিভিন্ন রকম পদ ঝড়ের বেগে তারা পরিবেশন করছে। তাদের নজর সবদিকে। কার কোথায় কি কম পরল যেন টেলিপ্যাথির মাধ্যমে তারা বুঝে যাচ্ছে।
মামাবাবু এবারে টেবিলের উপরে রাখা মেনুকার্ডে চোখ বুলাচ্ছেন। ওপরে লেখা—
কান্তি ক্যাটারার্স
নীচে
আজকের মেনু :
হাত কাটা বেগুনের কালিয়া
মাথা কাটা বাঁধাকপি
আজগুবি পোলাও
আহ্লাদী ইলিশ
খাসি খোশমেজাজ
চিংড়ি চমৎকার
শোল শোরগোল
চেটে খাব চাটনি
চমকানো চমচম
রসিক রাবড়ি
গায়ে কাটা কুলফি
ইত্যাদি প্রায় একশোর বেশি পদ।

সবগুলোই খেতে এমন চমৎকার যে কোনটা ছেড়ে কোনটা খাবেন ঠিকই করতে পারছেন না। অমিয়বাবু এসে একবার খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন, রান্না সব ঠিক আছে তো? সবাই অর্ধেক খাবার মুখে একগাল হেসে জানাচ্ছেন এমন খাবার তারা কখনো খায়নি।
অমিয়বাবু ভারী খুশি। অমিয়বাবুর দূরসম্পর্কের পিসি এসেছিলেন কলকাতা থেকে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি দারুন রান্না। এমন রান্না কোনো জন্মেও খাইনি।’ কোন ক্যাটারার্স রে ? চোখে ভালো দেখতে পাই না মেনুকার্ডে কি লেখা আছে পড়তে পারছিনা ছাই।
‘কান্তি, কান্তি ক্যাটারার্স পিসিমা।’
পিসিমা কানে কম শোনেন। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি বললি বাবা, শান্তি ? শান্তি ? ‘
শান্তি নয় কান্তি কান্তি-ই -ই-ই পিসিমা। যার মালিক হলেন নিশিকান্ত সাহা।পিসিমা আঁ আঁ শব্দ করে শব্দ তুলে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বাড়িতে হুলুস্থুলু লেগে গেল। ডাক্তার এসে একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে গেলেন পিসীমাকে। অমিয়বাবু খুব চিন্তিত। রাতটা পার হলে হয়।
বিয়ে সাঙ্গ হলে নিশিকান্ত আবার এসে হাজির। ‘কাল রাতে সব ঠিক ছিল তো ?’ নিশিকান্ত একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল।
‘ফাস্টক্লাস’, অমিয়বাবুর উচ্ছ্বসিত জবাব। শুধু খারাপের মধ্যে একটা। আমার পিসিমা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন।
নিশিকান্ত একটা খাম দিয়ে বলল’ ‘এর মধ্যে একটা কাগজ আছে। ওটা পড়বেন। আপনার পিসিমা হয়তো এই কারণেই অসুস্থ হয়েছেন। আমি আমার কর্তব্য করেছি। বাবা বলতেন ‘বিপদের দিনে কাজে আসে যে সেই তো আসল বন্ধু। আমাদের বিপদের দিনে আপনার বাবা আমার মাকে অনেক অর্থ সাহায্য করেছিলেন। সেই ঋণ শোধ হবার নয়।দরকার হলে আবার তলব করবেন। এখন আসি।’ বলে নিশিকান্ত লম্বা লম্বা পা ফেলে উঠোনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
অমিয়বাবু খামটা খুললেন। একটা পুরনো খবরের কাগজের অংশ।বহু পুরনো। প্রায় ৩০ বছর আগের। ভেতরে বড় বড় করে লেখা কলকাতা শহরের প্রসিদ্ধ কান্তি ক্যাটারার্স-এর ১০০ জন কর্মীর অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু। একটি বিয়েবাড়িতে হঠাৎ অগ্নিকাণ্ডে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় কান্তি ক্যাটারার্স-এর মালিক শশীকান্ত সাহা ও নিশিকান্ত সাহার।

দ্বৈতা হাজরা

[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *