March 17, 2018

[:bn]সবে মাত্র হালকা তন্দ্রার আমেজ এসেছিল, অকস্মাত্ অপরিচিত কন্ঠের আহ্বানে কিশোর  চোখ খুলতে বাধ্য হল। সামনে একজন মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে। লোকটি ইঙ্গিতে পা সরিয়ে বসতে বলল। অগত্যা প্রচুর বিরক্তি নিয়ে কিশোরকে উঠে বসতেই হল। লোকটি পাশে বসে বিদেশি সিগারেটে সুখটান দিতে শুরু করল। কিশোর রবাহুত লোকটার দিকে রোষকষায়িত দৃষ্টি হেনে চেয়ে পায়ে চপ্পল গলিয়ে উঠে দাঁড়াল, খুঁজে দেখা যাক এই পার্কে অন্য কোন বেঞ্চি খালি পাওয়া যায় কি না। ভদ্রলোক যেন একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন– ইয়ং ম্যান, আমি কি আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম? না, ঠিক আছে। নিরস মুখে জানাল কিশোর।

ভদ্রলোক সিগারেটের প্যাকেটটা কিশোরের সামনে এগিয়ে ধরলেন– হ্যাভ ওয়ান ! অপরিচিত লোকের দেওয়া জিনিস নিতে কিশোর সংকোচ বোধ করছে বুঝে ভদ্রলোক বললেন, হেজিটেট করবেন না? আসুন। সসংকোচে  কিশোর এবারে একটা সিগারেট তুলে নিয়ে বসতেই ভদ্রলোক লাইটার এগিয়ে ধরলেন।

ধন্যবাদ। কিশোর এতক্ষণে ভদ্রলোকের দিকে মনোযোগ দিল। ভরদুপুরে সাধারণত যেসব শ্রেণীর মানুষ জন পার্কে এসে ভিড় জমায় এই ব্যক্তিটি কখনই সেই দলের নন। লোকটির বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। দামি বেশভূষা, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখের ডিম্বাকৃতি রোলগোল্ডের চশমাটা ব্যক্তিত্বের যেন আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে। ভদ্রলোক গলা খাঁকরিয়ে বললেন, ইয়ং ম্যান, বেশ কিছুক্ষণ হলো আপনাকে অবজার্ভ করছি এই ভরদুপুরে পার্কের বেঞ্চে শুয়ে আছেন কেন জানতে পারি কি? অন্য কেউ হলে এই কথায় কিশোর হয়তো ঝাঁঝিয়ে উঠত কিন্তু ভদ্রলোকটি ইতিমধ্যে তার কাছে কিছুটা সমীহ আদায় করে ফেলেছেন তাই অন্য দিকে চেয়ে নিচুস্বরে বলল, এমনিই আর কি। লোকটি যেন কিশোরকে চোখ দিয়েই মাপজোক করতে শুরু করে দিয়েছেন। বললেন, তা নামটা বলতে যদি আপত্তি না থাকে।

কিশোর ব্যানার্জি।

ব্রাহ্মণ সন্তান ! ভদ্রলোকের ছেলে যে সেটা চেহারা দেখলেই বোঝা যায় এবং বেকার তাইতো? কিশোর সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। ভদ্রলোক প্যান্টের পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে কিশোরের দিকে এগিয়ে দিলেন। ‘ অমিয় সেন  — ফিল্ম ডিরেক্টার ‘.

এতক্ষণে কিশোর বুঝতে পারল এটা আর কেন চেনা মনে হচ্ছে। কয়েকদিন আগেই খবরের কাগজগুলো ফলাও করে অমিয় সেনের পুরস্কার প্রাপ্তির ব্যাপারে অনেক সুখ্যাতি করেছিল। আজকাল টিভির পর্দায় চোখ রাখলে মাঝেমধ্যেই স্বনামধন্য এই পরিচালককে দেখতে পাওয়া যায়। অমিয় সেন কিশোরের মুখের দিকে চেয়ে হাসলেন- অবাক হলেন নাকি?

অনেকটাই।

আপনি বোধ হয় সিনেমা জগতের খবরাখবর তেমন রাখেন না,না হলে আমাকে আগেই চিনে ফেলতেন।

কিশোর সসংকোচের জানালো সত্যিই আজকাল আর কোন কিছুরই খোঁজ রাখা হয় না। ভদ্রলোক একটা ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বললেন, ওয়েল,ইয়ং ম্যান, আপনার জানার কথা নয়। কিন্তু চলচ্চিত্র জগতে সবাই জানে আমি একজন বাস্তববাদী পরিচালক। আমার আগের দুটি ছবি ‘গঙ্গা নদীর মাঝি’ আর ‘১১৭/৫b ঘোষপাড়ার লেন’ দুটোই জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে সেটা শুধুমাত্র আমার ইনটেনসিভ রিসার্চ আর রিয়েলিস্টিক এপ্রোচ -এর জন্য। সিগারেটে টান দেওয়ার জন্য অমিয় একমুহূর্তের জন্য থামলেন।

কিশোর অবাক বিস্ময়ে অমিয় সেনের প্রতিটা কথা গোগ্রাসে গিলছিল।এ যাবৎ তার আঠাশ বছরের জীবনে এরকম খ্যাতিমান ব্যক্তির অকল্পনীয় সাহচার্য এই প্রথম। বড়সর একটা টান দিয়ে অমিয়  আধপোড়া সিগারেটের টুকরোটা পার্কের মাটিতে ফেলে দিয়ে বললেন, আমার প্রথম প্রজেক্টটির সময় প্রায় দু’বছর শংকরপুর জেলেপাড়ায় বাস করে মৎস্যজীবীদের জীবন ও জীবিকা কেয়ারফুলি ওয়াচ করেছিলাম। দ্বিতীয় ছবিটির জন্য হাওড়ার টিকিয়াপাড়া জুটমিলে শ্রমিকের কাজ করেছিলাম গোটা–এক বছর। সারা বছর ধরে কর্মচারীদের হাতের তালুতে ঢেলে খৈনি খাওয়া, যখন তখন গুটখা চিবানো, মুখ তুলে খিস্তি মারা– প্রতিটা ডিটেলসিই নোট  করলাম আর লাগিয়ে দিলাম তারপর রেজাল্ট সবাই জানে। এতক্ষন বলে ভদ্রলোক প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে অগ্নিসংযোগ করে বললেন, ওয়েল মিঃকিশোর একটা ছোট্ট ইন্টারভিউ নেব। যদি উৎরাতে পারো তাহলে আমার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাবে। রাজি আছো?

প্রচন্ড উত্তেজনায় কিশোরের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। কোনরকমে ঢোক গিলে মাথা নাড়লো। রিলাক্স ইয়ংম্যান, ভয়ের কিছু নেই, উত্তরগুলি সবই তোমার জানা। বাড়িতে আর কে আছেন?

আজ্ঞে স্যার বাবা এবং দাদা।

সোর্সেস অফ ইনকাম ?

বাবা রিটায়ার্ড ।পেনশন পান । আর দাদা একটা ছোট ব্যবসা করে।

পড়াশোনা ?

মাধ্যমিকে দুবার মানে ! কিশোর কথাটা শেষ সম্পন্ন করতে পারলো না।

বুঝেছি। কাজকর্ম কেন করো না ? আজ্ঞে সেরকম কিছু পাচ্ছি না, একটা জেরক্সের দোকানে বসতাম। কিছুদিন হলো সেটা যাওয়ার পর থেকে কিছুই জুটছে না।

প্রেম কর ?

না।

কখনো করোনি?

না।

চেষ্টা করনি?

হ্যাঁ স্যার করেছি ।

জোটেনি তাহলে?

হ্যাঁ, মানে। কিশোর লজ্জায় মাথা নীচু করলো।

বাড়িতে গঞ্জনা জোটে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আমিয় উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ভায়া ঠিক তোমাকেই খুজছিলাম হে ! আমার হিরো রুদ্র শেখর তোমার মতোই একজন বেকার যুবক, তার জীবনে কিছুই নেই এমনকি প্রেরণা প্রেমও না। রুদ্রকে ঠিক মতো বুঝতে হলে তোমার সাহায্যের একান্ত প্রয়োজন। অমিয় হাতের ঘড়ি দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন— চল হে আর দেরি করে কাজ নেই। আশান্বিত কন্ঠে কিশোর বলল, কোথায় যেতে হবে স্যার?

নিউ আলিপুরের রায়বাহাদুর রোডে। ওখানেই আজ আমার কাজ চলছে ।

এরকম বিলাসবহুল গাড়ি রাস্তায় অনেক দেখে থাকলেও এতে চাপার অভিজ্ঞতা কিশোরের এই প্রথম, সে যেন কোথায় শুনেছিল বিগত দিনের হিন্দি ছবির এক মহানায়ক ঠিক এভাবেই অযাচিত সুযোগ পেয়েছিলেন, তার পরে বাকিটা ইতিহাস। বাতানুকুল গাড়ির শীতল অভ্যন্তরেও কিশোরের কপালে ঘাম জমতে লাগলো। বাবা আর দাদার মুখটা মনে পড়ল। তারা যখন সবকিছু জানতে পারবে তখন তাদের হতবাক হওয়া মুখগুলোর কথা ভেবে হাসি পেল। আর মনে পড়লো স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক পাল বাবুর কথা। এক ক্লাস ছেলের সামনে কান টেনে তিনি বলেছিলেন, গাধা কোথাকার, স্কুলে সময় নষ্ট না করে বাবাকে বল একটা আলু-পিঁয়াজের দোকানে বসিয়ে দিতে, তাও দুটো পয়সা রোজগার করতে পারবি। কিছুদিন আগে রাস্তায় পাল বাবুর সঙ্গে দেখা। ভদ্রলোক অবহেলার সঙ্গে বললেন, তা আজকাল করছিস কি? আলু-পটল বেচছিস -নাকি রিক্সা টানছিস? কিশোরের বলতে ইচ্ছা হয়েছিল, আলু-পটল না খেলে তো আপনার একটা দিনও চলবে না। কিন্তু মুখের ওপর আর কথা বলা হয়নি। এরপর ডলির কথা ভাবতেই কিশোরের বুকের ভিতর চিনচিন করে উঠলো। পাড়ার সত্যবাবুর মেয়ে ডলি যেন কিশোরকে মানুষ বলেই মনে করতে চায় না।ডলি  যদি একটি বারের জন্যও ওর দিকে চেয়ে একটা মিষ্টি হাঁসি হাসত তাতেই  কিশোরের হৃদয়টা পাওয়ার সুখে ভরে যেত। ডলি সুন্দরী, শিক্ষিতা, স্মার্ট নিশ্চয়ই উপযুক্ত ছেলের সঙ্গেই বিয়ে হবে। ফালতু ছেলেদের দিকে ফিরে চাইতে তার ভারী হয়ে গেছে। খোলা চোখে কিশোর দেখতে পেল অনুতপ্ত ডলি ভেজা চোখে ক্ষমা চাইতে এসেছে  খ্যাতির চূড়ায় বসে থাকা এই কিশোরের কাছে। সে নিজের ক্ষমতায় আজ চিত্র জগতের এক মহা নক্ষত্র। ডলির থেকেও রূপে-গুণে সেরা ডাকসাইটে সুন্দরীরা  তার ইঙ্গিতে জীবন বিসর্জন দিতে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তবুও কিশোর দেখিয়ে দেবে সে একজন খাঁটি মানুষ আর তাই সে ডলির সব অপরাধ ক্ষমা করে তাকে কাছে টেনে নিতে এখনো আগের মতোই প্রস্তুত। চোখে জল এসে গেছিল, আমিওর ডাকে সম্বিৎ ফিরল। কি হে কাঁদছ কেন? কিশোর দ্রুত সংযত হল, না, মানে, এমনি। চোখে একটু  প্রবলেম আছে তো তাই।

আমরা এসে গেছি।

গাড়ি থেকে এসে থেমেছে নিউ আলিপুরের রায়বাহাদুর রোডে। সামনে প্রাসাদোপম বাড়িটি যাতায়াতের পথে আরও দু একবার কিশোরের চোখে পড়েছে। গাড়ি গেটের সামনে দাঁড়াতেই উর্দি পরা দারোয়ান ছুটে এসে গেট খুলে দিল। গোলাকৃতি একখণ্ড বাগানের ওপারে হলদে রংয়ের সাবেক আমলের বাড়িটা শুটিংয়ের কাজে প্রায় ব্যবহার হয়। সদর দরজার সামনে দুজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। তারা এগিয়ে আসতেই অমিয় তাদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিশোর দেখতে পেল আমিও তার দিকে আঙ্গুল তুলে লোকগুলোকে কিছু বলছে। এবার ওদের একজন গাড়ির সামনে এগিয়ে এসে বলল, নেমে এসো ভাই। আমি এসিস্টেন্ট ডিরেক্টর বিধুভূষণ। আমাকে ফলো কর। দুরুদুরু বুকে কিশোর বিধুভূষণ এর সঙ্গে বাড়ির ভিতরে এগিয়ে চলল। বিশাল আকারের হল ঘরে তখন জনা বিশেক লোক ইতস্তত এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। জায়গায় জায়গায় শুটিংয়ের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ছড়ানো। এর কিছু কিছু কিশোর টিভিতে দেখেছে । হল ঘরের মাঝখান দিয়ে বাহারি কাঠের সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে। কিশোর দেখে চমকে উঠল পাশাপাশি বসে বাংলা সিনেমার হিট নায়ক রবি কুমার, উঠতি নায়িকা নবনীতা, আর আগেকার আমলের অভিনেত্রী অজন্তা দেবী। নবনীতাকে চড়া মেকআপে দারুন সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু আমিও গেলেন কোথায়, তাকে তো দেখা যাচ্ছে না।বিধু পুলক বলে হাঁক দিতেই চালাক চালাক চেহারার একটা ছোকরা গলায় ক্যামেরা  ঝুলিয়ে এসে হাজির হল। ছোড়া টাকে একটু দূরে  গিয়ে কিছু বোঝাতেই ছেলেটি ক্যামেরা হাতে কিশোরের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালো। পর মুহূর্তে কিশোরকে চমকে একের পর এক ক্যামেরার ফ্লাশ তার মুখের ওপর টিপতে লাগল। বেজায় হকচকিয়ে কিশোর বলল এসব কি হচ্ছে দাদা। বিধুভূষণ-এর মুখে মুচকি হাঁসি, তোমার কয়েকটা এক্সপ্রেশন  ধরে রাখা হলো হে, পরে কাজে দেবে। তার ছবি কার কি কাজে লাগবে সেটা জিজ্ঞেস করার সাহস আর কিশোরের হলো না। এমন সময়ে অমিয়র প্রবেশ। দুই হাতে তালি বাজিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তৃতা দেবার ভঙ্গিমায় অমিয় বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেন।

উচ্চস্বরে আমিয় বলতে শুরু করলেন— লিসন এভরিওয়ান,  তোমাদের সঙ্গে আজ একজন ইয়ংমেনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব যার নাম কিশোর ব্যানার্জি। অমিয় ইশারা করে ডাকতেই কিশোর স্মার্ট হওয়ার চেষ্টায় কায়দা করে হেঁটে পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কিশোরের পিঠে আলগোছে হাত রেখে অমিও বললেন, তোমরা হয়তো শুনে অবাক হবে কিশোরের সঙ্গে আমার আলাপ মোটে কয়েক ঘন্টা আগে হয়েছে। আজ দুপুর বারোটার সময় ওকে আমি প্রথম দেখি। তোমরা কেউ আন্দাজ করতে পারো এই নব্যযুবকটি তখন ঠিক কি করছিলেন ?কিশোর মনে মনে প্রমাদ গুনল, এসব কথায় আবার এখানে কি প্রয়োজন ! সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে দেখে অমিয়ই বলে যেতে লাগলেন, হয়তো তোমাদের বিশ্বাস করতে অসুবিধে হবে এই এন্টারপ্রাইজিং জেন্টলম্যানটিকে আমি গভীর নিদ্রামগ্ন অবস্থায় আবিষ্কার করি কালীঘাট পার্কের কর্নার বেঞ্চি থেকে। ভালো করে অবজার্ভ করতে বুঝলাম এর মতো কারো সন্ধানই গত একমাস ধরে রাস্তায় রাস্তায় পার্কে পার্কে নিষ্ফল ঘুরে বেরিয়েছি। তোমরা জানো আমাদের ছবির প্রটাগোনিস্ট একজন শহুরে মধ্যবিত্ত যুবক। রুদ্রশেখর বেকার হলেও লড়াকু মানুষ, যেমন এই কিশোর আর কি! তোমরা সহজেই রুদ্রশেখর আর কিশোরের মধ্যে সিমিলারিটি খুঁজে পাবে। কিশোর এই মুহূর্তে আমাদের সামনে সমগ্র বেকার সমাজকে রিপ্রেজেন্ট করছে।বেকারত্বের হতাশা আর গ্লানিতে জর্জরিত কিশোরের না আছে পেটে ভাত না আছে মাথায় তেল। ওর পায়ের চটিটা তোমরা খেয়াল করো , সামনের স্ট্র্যাপের ছেড়া অংশে বড় বড় তাপ্পি মারা। শার্টের বুক পকেটের অবস্থাও  শোচনীয়, এসব থেকে কিশোরের আর্থিক পরিস্থিতির স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। তবে ভদ্রবংশের ছেলে, চুরি-ছিনতাইটাও ওকে দিয়ে হবে না। দু’বেলা দুমুঠো ভাতের বিনিময়ে বাড়িতে বাবা- দাদার গঞ্জনা নিত্যদিনের প্রাপ্য ।তাহলে কিশোরের জীবনে রইল কি ? প্রেম ! কায়দা করে হেসে অমিয়  বললেন, কলকাতার চালু মেয়েরা আজকাল আর বেকার ছেলেদের পাত্তা দেয় না। সুতরাং প্রেম নেই। তাহলে সে শেষমেশ কি থাকল? সবার উপর চোখ বুলিয়ে অমিয়ই  উত্তর দিলেন, থাকল এই সমাজ ব্যবস্থার প্রতি অব্যক্ত ঘৃণা, বুক ভরা বিপ্লবের দুর্মর বাসনা, সবকিছু ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়ার তীব্র আক্রোশ আর আছে ওর শরীরের অন্তহীন খিদে ! হ্যাঁ, হ্যাঁ সেক্স। বেকার এই কিশোর কামনার আগুনে প্রতিনিয়ত জ্বলে পুড়ে মরে তারপর প্রতি রাতে ওর অর্থহীন জীবনে নেমে আসে অসীম শূন্যতা আর হতাশা। একটানা বলে আমিয় একটু থামলেন, ওদিকে দারুন অপমানে কিশোরের গা রি-রি করে জ্বলছে। মাথা নিচু করে মনে মনে চিৎকার করে উঠল– আমার ভিতর যেমন সেক্স আছে, তোর ভিতরে তেমনই রয়েছে নর্মদার কাদা,বেল্লিক কোথাকার ! অমিয় বলেই চলেছেন — তোমরা জানো আই বিলিভ ইন পারফেকশন, এই ছবিতেই আমি জাতীয় পুরস্কারের হ্যাটট্রিক সেরে ফেলতে চাই। তবে তোমাদের এক্টিভ কো -আপারেশন ছাড়া সেটা সম্ভব নয় বলাই বাহুল্য। অমিয় এবার রবির দিকে বললেন, যদি রুদ্রশেখরকে বুঝতে চাও, তাহলে কিশোরকে কেয়ারফুলি ওয়াচ করো ।তুমি ওর প্রতিটা মুভমেন্ট নোট কর, প্রতিটা এক্সপ্রেশন যে মূল্যবান, আশাকরি তোমাকে সেটা বোঝাবার দরকার নেই। অমিয়র ভাষণ শেষ হল, একজন সহকারী এসে নিচুস্বরে কিছু বলতেই ব্যস্ত হয়ে বাড়ির দোতলার দিকে অগ্রসর হলেন। অমিয় সামনে থেকে সরে যেতেই অজন্তা অবজ্ঞাভরে বলে উঠল– এই ডিরেক্টরের নির্ঘাত মাথা খারাপ, এরকম ডেকরা নিষ্কর্মা মোড়ের চায়ের দোকানটায় জনাদশেক মকশো করছে দেখে এসো গে যাও, তার থেকে একটা ধরে নিয়ে এলেই তো বাবা, তার জন্য ভরদুপুরে কলকাতা চষে খেতে হয় ! অজন্তার কথায় সায় দিয়ে রবি বলল– বিপ্লবের চিন্তা মাথায় নিয়ে কেউ দিনে দুপুরে পার্কের সিটে নাক ডাকায় না, অমিয়দা  যে কোত্থেকে সব ধরে নিয়ে আসেন আবার সেটাকে নাকি স্টাডিও করতে হবে, যত্তসব ! মুচকি হেসে নবনীতা মাঝখান থেকে ফোড়ন কাটল– আমার তো মনে হচ্ছে একটা কথাই ঠিক। ওই যে সেক্সের ব্যাপারটা দেখে মনে হচ্ছে যেন জন্মের খিদে নিয়ে বসে রয়েছে। এই কথায় উপস্থিত সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। কিশোরের মনে হল তার দুই কানের নিচে কেউ ধাঁ ধা করে চড় বসিয়ে দিল। মনে মনে চিৎকার করে বলল, হ্যাঁ– আমি বেকার। তাতে তোদের বাবার কি ! আমি তোদের খাই না পরি ? কিশোরের পরিত্রাণে বিধুভূষণ এগিয়ে এল—- চলো হে ,এখানে এখন তোমার কোন কাজ নেই।

সেই ভালো। যাওয়াই যাক ।এই স্বার্থপর অমানুষগুলোর মাঝখানে কিশোর আর এক মুহূর্ত থাকতে চায় না।

 

বিধু কিশোরকে সটান দোতলায় এনে হাজির করল। একটা ছোট ঘরের এক কোনায় প্রচুর কাপড়চোপড় ডাই করে পড়ে রয়েছে। ঘরের মাঝখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খানকয়েক প্রমাণ সাইজের প্লাস্টিক মডেল ফেলে রাখা আছে । এই ধরনের পুতুল পোশাকের দোকানগুলোর শোকেসে সাজিয়ে রাখা হয়। বিধু ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে বলল—- ওহে, তোমার পার্টটা এবার ভালো করে বুঝে নাও। নায়িকা নবনীতা তার ঘরে একা শুয়ে ঘুমোচ্ছে আর সেই সুযোগে তুমি চোরের মত পা টিপে টিপে গিয়ে তার গালে চটাশ করে একটা চুমু বসিয়ে দেবে। কিশোর ভয়ানক রকম ঘাবড়ে গেল। এই লোকগুলো কি তার সঙ্গে তখন থেকে নির্মম রসিকতা করে চলছে নাকি? কিশোরের হতভম্ব ভাব দেখে বিধু হেসে ফেলল, দাড়াও আগে তোমার একটা ছবি তুলি। গলায় ঝুলানো ডিজিটাল ক্যামেরাটা কিশোরের মুখের দিকে তাক করে সুইচ অন করতেই ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠল।কিশোরের মনে এবার খানিকটা সন্দেহ জেগে উঠল। বলল– আপনারা ঘন ঘন আমার ছবি তুলছেন কেন?

অমিয় দার সেই রকমই নির্দেশ আছে হে তোমার প্রতিটা এক্সপ্রেসন তার চাই। অভিনয়ের ব্যাপারে যেন কী বলেছিলেন।বিধু ফিচেল হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল, বললাম তো জীবনে এর চেয়ে সহজ কাজ আর পাবেনা ভায়া। একটা ঘুমিয়ে থাকা মেয়েকে ! যাকগে ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা পুতুলগুলো দেখেছ, ওগুলো একটা কাপড়ের দোকানে ছিল, বাতিল হবার পরে ডেকোরেটর এখানে রেখে গেছে। ওর একটা তুলে চুমু খাওয়া প্রাকটিস করতে পারো। বিধু ভূষণ চলে গেল। কিশোর একা বসে চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল। সবাই বলে কিশোর নাকি একটা অপদার্থ। এতগুলো বছরের ব্যর্থতায় আজকাল সে নিজেও তাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। সমবয়সী বন্ধু বান্ধবেরা আজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত । কিশোরকে তারা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে বললেই তার ধারণা।কিশোর মাঝেমধ্যে ভেবে কষ্ট পায়, তাকে দিয়ে কেন সেরকম কিছু হল না ! এই বয়সেও সাইকেল চালাতে গেলে টাল সামলাতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ে, হিসেব করতে গেলে গোলমাল করে ফেলে। একটা প্রেমও যদি প্রেম করতে পারত।

কিশোরের চিন্তায় ছেদ পড়ল। ফের বিধু ভূষণ এসেছে।

ওহে অমিতা লাঞ্চের জন্য ডাকছেন।  কিশোর একটা মডেল তুলে নিয়ে বলল, দেখুন বিধুদা, অভিনয় কেমন হচ্ছে। কিশোর মডেলের গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। বিধু ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বলল, দেখ ভাই, পুতুল গুলোকে ইচ্ছা চাপতে পারো তাতে কারো কিছু বলার নেই তবে তাই বলে আবার হিরোইনকে অমন চটকাতে যেও না যেন, তোমার বাপের মাল নয় হে।

কিশোর মনে মনে বিধু ভূষণের মুন্ডুপাত করল,এ তো আচ্ছা ছোটলোক দেখছি, একফোঁটা ভদ্রতাও শেখেনি।

লম্বা বারান্দাটা পেরিয়ে দোতলার অন্য প্রান্তে একটা ঘরে খাবার ব্যবস্থা হয়েছে। টেবিলের ওপর রংচঙে প্লাস্টিকের চাদর পেতে চীনে মাটির পাত্রে প্রচুর পরিমাণে ফ্রাইড রাইস জাতীয় খাদ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে, সঙ্গে রয়েছে খাসির কষা মাংস আর স্যালাড।খাবারের গন্ধ নাকে আসতেই কিশোরের পেটে ঘুমিয়ে থাকা খিদেটা গা ঝাড়া দিয়ে উৎকট ভাবে নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে শুরু করল। ঘরে তখন ইউনিটের লোকজনের জটলা, অনেকেই প্লেটে খাবার তুলছে,কেউ কেউ আবার ইতিমধ্যে খেতে বসে পড়েছে।জানালার ধারে চেয়ারে বসে অজন্তা দেবী প্লেট ভর্তি মাংস আর ফ্রাইড রাইস মন দিয়ে খাচ্ছিলেন। কিশোরের সঙ্গে চোখাচুখি হতেই অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। কিশোরের মনে পড়লো, এই অভিনেত্রী অনেক আগে বিখ্যাত নায়ক উদিত গোস্বামীর নায়িকা হয়ে বাজার কাঁপিয়েছিলেন। তখন তাঁর সে কি সুন্দর চেহারা ছিল ! আর এখন সর্বাঙ্গে বয়সের ছাপ স্পষ্ট, ভারী শরীরে নড়াচড়া যে কি করেন তা আবার অভিনয় !

অমিও কিশোরকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন— এসো ভাই আজকের মেনুটা আবার একটু হেভি , তোমার চলবে তো ! জিভের গোড়ায় এসে যাওয়ার জলটাকে গলার ভিতর চালান করে কিশোর বলল হ্যাঁ স্যার অবশ্যই।

তবে কি জানো রবি আর নবনীতা এসব খাবার মুখে তুলবে না। ওরা শুধু স্যালাড আর ফলের জুস দিয়েই লঞ্চ সারবে।

কিশোরের বয়ে  গেছে কে কি খাবে তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে। এক্সিডেন্টে মরুক রবি, আর জাহান্নামে যাক নবনীতা। সে একটা  প্লেট তুলে অঢেল পরিমানে মাংস ভাত ভরে নিল, আচমকা আবার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। কিশোর তাকিয়ে দেখল বিধু তার কাজ শুরু করেছে।মরুকগে ! কিশোর এখন কোন দিকে তাকাতে চায়না।

মুখে গ্রাস তোলার আগেই হঠাৎ বিধু এসে  কিশোরের উদ্যত হাত চেপে ধরল– করো কি হে তুমি দেখছি কাজের বারোটা বাজিয়ে তবে ছাড়বে। এইসব খেয়ে ইন্টিমেট সিনে পার্ট করবে ! কিশোর ভ্যাবাচাকা খেয়ে দেখে বিধু ফের ক্যামেরা তাক করল।

অমিও বললেন, আরে তাইতো, ভাগ্যিস তুমি মনে করেছিলে। আমি তো ভুলেই গেছিলাম লাঞ্চের পরে আবার এই শটটা নিতে হবে। মুখে একটু গন্ধ পেলে নবনীতা আবার বেঁকে বসতে পারে। বিধু কিশোরের হাত থেকে প্লেট কেড়ে নিল, চল ভাই, তোমার জন্য অন্য ব্যবস্থা করেছি। কষা মাংসের দৃষ্টিকে হতাশ দৃষ্টি মেলে নিরুপায় কিশোর বিধুর সঙ্গ নিল। নবনিতাকে চুম্বন করার চেয়েও এই মুহূর্তে তার কাছে বড় আকর্ষণ ওই ফ্রাইড রাইস আর মাংসের।

একরাশ মন খারাপ নিয়ে কিশোর দোতলার সেই পুরনো ঘরে গাধা ভর্তি পুতুলের মাঝে বসে বিধুভূষণ এর অপেক্ষা করছে। প্রায় একঘন্টা পরে হাতে একটা কাগজের ঠোঙ্গা নিয়ে বিধুর প্রবেশ।

আর তো কিছুই জোগাড় হলো না ভায়া। ঠোঙা থেকে বের করে দুটো বাঁশি কলা আর কয়েকটা শুকনো পাউরুটি।

ওতেই হবে। ক্ষুণ্ন মনে পাউরুটি কলা চিবুতে চিবুতে কিশোর দেখল আবার তার ক্যামেরা তুলে ধরেছে। ক্লিক !

একটু আগেই কিশোরের ডাক এসেছে। হঠাৎ নিজের পা দুটো কে পাথরের মতন ভারী লাগতে শুরু করেছে। মন বলছে এই লোকগুলোর উদ্দেশ্য সৎ নয়, কিন্তু বাবা দাদার মুখ মনে পড়তেই কিশোর একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল, শেষ না দেখে আজ আর বাড়িমুখো হচ্ছে না কিছুতেই।
নিচের ঘরের একপাশে একটা বাহারি পালঙ্কের তিন ধারে পর্দা দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। জনাদশেক লোক খেটেখুটে সবকিছু একেবারে নিখুঁত করে সাজিয়ে তুলতে ব্যস্ত। সামনে হালকা মেকআপ নিয়ে দাঁড়িয়ে নবনীতা। লাল সিল্কের শাড়ি পড়ে নবনীতা কে যেন আরও আকর্ষণীয় লাগছে।অমিয় নবনীতার সঙ্গে কিছু আলোচনায় করছিলেন, সেটা শেষ করে কিশোরকে আপাদমস্তক দেখে বললেন— তোমাকে দেখে তো কম্ফোর্টেবল বলে মনে হচ্ছে না হে !
কিশোর ঢোক গিলে বলল, মনে হচ্ছে এই সিনে আমি অভিনয় করে উঠতে পারব না। অমিয় এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তারপর গলা উঁচিয়ে বললেন– ওহে তোমরা সবাই মানে বিধু আর নবনীতা কে বাদ দিয়ে বাকি সবাই একটু পাশের ঘরে যাও দেখি। পরিচালকের নির্দেশে তখনই ঘর ফাঁকা হল। অমিও আন্তরিক স্বরে বললেন, জীবনের প্রথম শট তাও এরকম ডেলিকেট একটা ম্যাটার , অসুবিধেটা বুঝতে পারছি তবে যাই হোক না কেন কাল সকালে যখন ফের সূর্য উঠবে তখনও কিন্তু এই সত্যটা পাল্টাবে না যে তুমি বেকার এবং সেই বাস্তবটা পাল্টাবার এই একটাই সুযোগ তোমার সামনে। তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে অন্য কেউ এটা করতে দ্বিধা করবে না। যাই হোক, আমার হাতে নষ্ট করার মত সময় কিন্তু এক সেকেন্ডও নেই। আমিয় জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে চেয়ে রয়েছেন। কিশোর মনে জোর এনে জানাল সে রাজি । অমিও মৃদু হেসে বললেন, ঘরে এখন সেরকম কেউ নেই, একটা রিহার্সাল করা যাক। দৃশ্যটা বুঝে নাও। নায়িকা নবনীতা তার বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। এই মুহূর্তে বাড়িতে কেউ নেই। তুমি কোনক্রমে ঢুকে পড়েছে। সুযোগ বুঝে বাসনা চরিতার্থ করার জন্য ঘুমন্ত মেয়েকে তুমি চুম্বন করার চেষ্টা করবে। ঠিক আছে ?
একটা প্রশ্ন কিশোরের মনে ঘোরাফেরা করছিল। এবার অসংকোচে জিজ্ঞেস করল– আপনার ছবিতে আমার ভূমিকাটা ঠিক কি ? অমিও যেন এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, থতমত খেয়ে গেলেন আগে শটটা হয়ে যাক পরে বলব। তারপর বৃদ্ধির দিকে ফিরে বললেন– বিধু, তুমি রেডি তো ? বিধুভূষণ সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই এবার নবনীতার দিকে ফিরে বললেন– নবনীতা, বিছানার ঠিক ডান পাশ ঘেঁষে শুয়ে ঘুমোবার অভিনয় করবে। উদ্বিগ্ন স্বরে নবনীতা বলল– অমিয়দা, শেষে সবকিছু ঠিকঠাক মিটবে তো ?
অমিয় হাত তুলে নবনিতাকে আশ্বস্ত করে বিধুর দিকে ফিরলেন, প্রতিটা এক্সপ্রেশন ক্যাপচার করবে, একটাও যেন মিস না হয়। ভালো কথা, কিশোর তুমি রেডি?
হ্যাঁ।
ফাইন ,এবার তাকিয়ে দেখ বিছানার উপর সুন্দরী নবনীতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এতদিন সিনেমার পর্দায় নিশ্চয়ই ওকে দেখেছ। অসম্ভব আজ বাস্তব হয়ে তোমার চোখের সামনে উপস্থিত। যাও, সবকিছু ভুলে গিয়ে ওকে ছুয়ে দেখ। হঠাৎ কিশোরের মনে হল তার সুপ্ত অনুভূতি গুলো যেন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। কি সুন্দর না দেখাচ্ছে নবনিতাকে এমনকি ডলির থেকেও সুন্দর। অনেককাল আগে কিশোর স্বপ্ন দেখত তারও এরকম সুন্দরী কোন মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হবে। আজ অদ্ভুত এক যোগাযোগের মধ্য দিয়ে ভাগ্য তাকে স্বপ্নপূরণের জায়গায় নিয়ে এসেছে। অমিও,বিধু এমনকি নিউ আলিপুরের এই প্রাসাদটাকেও ভুলে সে ধীর পায়ে ঘুমন্ত নবনীতার দিকে এগিয়ে চলল। একবার ছুঁয়েই সে পরখ করতে চায় এসব কি শুধুই স্বপ্ন ? নাকি ঘুম ভাঙলে রূঢ় বাস্তব তার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। কিশোরের সঙ্গে সুন্দরীর দূরত্ব ক্রমশ কমছে। কিশোর দেখতে পাচ্ছে নবনীতার ঠোঁটের ঠিক উপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কিন্তু আর যে এগোনো যাচ্ছে না, পা দুটো যেন অকারণেই মেঝের সঙ্গে গেঁথে গেছে। কিশোর কুলকুল করে ঘামতে লাগল, হুশ ফিরল যখন কেউ তার চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। প্রচন্ড ধাক্কায় কিশোরকে মেঝেতে ছুরে ফেলে একটা ষণ্ডা গোছের লোক বুকের উপর চড়ে বসে এলোপাথাড়ি কিল চড় খুশি মেরে কিশোরকে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ফেলল। ইতিমধ্যে বিধুর হাতের ক্যামেরাটা অন্তত বার দশেক ঝলসে উঠেছে।

কিশোরকে দোতলার সেই ঘরে নিয়ে গিয়ে শেষে ফার্স্ট এইড দেওয়া হয়েছে। ঠোঁটটা বিশ্রীভাবে কেটে ফুলে গিয়েছে। ডানপাশের গালে মারের চোটে কালশিটে দাগ বসে গেছে। বিধুভূষণ এসে জানিয়ে দিয়েছে, কিশোরের কাজ শেষ হয়ে গেছে এখন সে চাইলে যেতে পারে। দুশ’টা টাকাও দিতে চেয়েছিল কিন্তু কিশোর টাকা নিতে রাজি হয়নি। সে শুধু একবার অমিয়র সঙ্গে দেখা করতে চায় শেষবারের জন্য। জানা গেল অমিয় এখন কাজে ব্যস্ত, অন্তত ঘন্টা তিনেকের আগে দেখা হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। কিশোর অবশ্য অপেক্ষা করবে প্রয়োজন হলে সারারাত।
সন্ধের পর বিধুভূষণ এসে হাজির হল। কিশোরকে দেখে ভ্রু তুলে বলল– কি হে তুমি এখনো বিদেয় হওনি কেন ? কিশোর উত্তর দেওয়ার আগেই বিধু ফের বলল, অমিয়দার সঙ্গে ফালতু দেখা করে লাভ নেই। তোমার মত নভিসকে উনি পাত্তা দেবে না। তাছাড়া কাল সকাল থেকেই শুটিং, ভালো করে হয়তো কথাই বলবেন না।
কিশোর অনুনয়ের সুরে বলল— তাহলেও একবার যদি দু’মিনিট সময় দিতেন। বিধু বিরক্ত কন্ঠে বলল —ঠিক আছে শুনবে না যখন চলো তাহলে, আমাদেরও বাড়ি যাবার সময় হয়ে এসেছে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় কিশোর দেখল ইউনিটের লোকেরা প্রায় সবাই চলে গিয়েছে শুধু বিধু আর ড্রাইভার কে বাদ দিয়ে কে একটা কাঠের টুলে বসে কিছু দিয়ে কান খুঁচিয়ে চলেছে। বিধু বোধ হয় অমিয়র সঙ্গেই যাবে। একতলায় পরিচালকের অফিস। রিভলবিং চেয়ারে বসে ল্যাপটপের স্ক্রিনে অমিয় চোখ বোলচ্ছিলেন। কিশোরকে দেখে মৃদু হাস্য করে বললেন— কি হে, তোমার মজুরিটা রিফিউজ করেছ কেন?
কিশোর সংযত কন্ঠে বলল– মার খাওয়ার মজুরি !
অমিয় হালকা চালে বললেন– মহান অনেক রচনার আড়ালে ছোটখাটো কিছু স্যাক্রিফাইস থেকেই যায় যেটাকে সবসময় গুরুত্ব দিয়ে বিচার না করলেও চলে। তোমার হয়তো কিছুটা চোট লেগে থাকতে পারে কিন্তু একবার ভেবে দেখো আমার ছবির নায়ক আর তোমার মধ্যে কি অসম্ভব মিল। সেও এক দলছুট বেকার ঠিক তোমারই মতন। এরকম একটা মানুষের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ফিলিংস ভিতর থেকে টেনে সামনে এনে ফেলার ক্ষমতা আমার বা এই ছবির নায়কের নেই। তাই সবকিছুই হয়ে যাচ্ছিল গতানুগতিক, হাজার খুঁজেও একটা পারফেক্ট বেকারের খোঁজ পেলাম না। তোমার সঙ্গে দেখা। জেলেদের সঙ্গে থেকে বা শ্রমিকের সঙ্গে কাজ করে হয়ত তাদের সমস্যার দিকটা বোঝা যায় কিন্তু নিজেকে কিছুতেই খাঁটি বেকারত্বের সঙ্গে আইডেন্টিফাই করতে পারছিলাম না। এ জীবনে আর তা পারবোওনা। আজ দুপুরে যখন তোমায় প্রথম দেখলাম তখন তুমি দিনদুপুরে ঘুমাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলে। এটা জীবনের প্রতি এক ধরনের রেজিগনেশন। যখন সেই তোমাকেই অকল্পনীয় সুযোগের সন্ধান দিলাম তখন কিছু আগে তোমার বিতশ্রদ্ধ দু’চোখে সেকি উদ্দীপনা ! সামনে যখন সুখাদ্য ধরা হল তখন মুখের রেখায় জলন্ত লোভ যেটা অন্তত রবি দেখাতে পারত না আবার যখন খাবারটা কেড়ে নেওয়া হলো তখন যেন হতাশার খাদে ডুবে গেলে সেই তুমিই । নবনীতার মত মেয়েকে সামনে দেখাটা যদি তোমার সৌভাগ্য হয় তাহলে তাকে ছুঁতে পারার সুযোগে তোমার চোখে সেকি নির্লজ্জ বাসনা ! পরের মুহূর্তেই বাধা পেয়ে কামনা পরিণত হলো ক্রোধে, তারপর যখন ধোলাই চালু হলো তখন একসঙ্গে আতঙ্ক যন্ত্রনা সবকিছু প্রত্যেকটা স্পনটেনাস রিএকসানি ক্যামেরায় ধরা হয়েছে। আশা করি তোমার কেসটা ঠিকমতো স্টাডি করে আমার প্রোজেক্টেটাকে বেটার শেপ দিতে পারব। দ্যাটস ইট । কিশোর এতক্ষণ একমনে কথা শুনছিল। অমিও থামতেই বলে উঠল, এখন আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারছি। এবারে আমি বাড়ি যেতে চাই। তবে একটা শেষ অনুরোধ যদি রাখেন। অমিয়র মুখে বিরক্তির অভিব্যক্তি দেখে কিশোর হাসার চেষ্টা করল- চিন্তা নেই স্যার, সেরকম কিছু চেয়ে আপনাকে বিব্রত করব না । একটু দম নিয়ে কিশোর ফের বলল, হয়ত এই জীবনে আপনার মত এত বিখ্যাত মানুষের সামনে দাঁড়াবার দ্বিতীয় সুযোগ আর আসবে না। কার মুখ দেখে যে ঘুম থেকে উঠেছিলাম ! আপনার হাত ধরেই এই বাড়ীতে এসেছিলাম তারপর বিখ্যাত সব সেলিব্রিটিদের সঙ্গে কাজ করার এমন অভিজ্ঞতা। এখন যদি শেষ মুহূর্তে দয়া করে আমাকে একটু গেট অব্দি এগিয়ে দেন তাহলে আজকের দিনটা আমার জীবনের চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তোয়াজে অমিও বিলক্ষণ সন্তুষ্ট হয়ে পড়লেন কারণ তিনি বিধুর দিকে চেয়ে বললেন, বিধু , সব গোছগাছ করে নাও, এবারে আমরা বাড়ি যাবো। চল হে কিশোর, তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আসি।
সদর দরজা খুলতেই দমকা হাওয়া কিশোরের চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিল। দারোয়ানকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কিশোর মনে মনে খুশি হল। যাক, এবার তার কাজ আরও সহজে হবে। অমিয় একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়লেন। এতক্ষণে কিশোর নিজের মনের কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। শান্ত অথচ কঠিন স্বরে বলল, একটা কথা বলব স্যার। সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে অমিয় বললেন, বলে ফেলো।
গিনিপিগ নামে একটা প্রাণীর কথা শুনেছেন ? মানুষের নানারকম গবেষণার কাজে এদের ব্যবহার করা হয়। তবে এই গিনিপিগ গুলোর অধিকাংশই হয় মারা যায় না হয় বাকি জীবনে আর চলার যোগ্য থাকেনা। হাতের সিগারেটটা বাগানের একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অমিও তাচ্ছিল্যভরা ভরা স্বরে বললেন, এবার তুমি আসতে পারো। কিশোর গলার স্বর চরাল– একটা কথা শুনে যান, মিস্টার সেন। মানুষের মধ্যে এমন একটা জিনিস আছে যা ওই গিনিপিগের ভেতরে নেই। সেটা হচ্ছে বিবেক যেটা আবার আপনার ভিতরে নেই, যদিও আপনাকে দেখতে অনেকটা মানুষেরই মতো।
ওয়ার্থলেস স্টুপিড ! তীক্ষ্ণ বিদ্রূপাত্মক হাসি কিশোরের মুখে নিক্ষেপ করে চলে যাওয়ার জন্য অমিও পিছন ফিরলেন আর ঠিক তখনই উঠোনে পড়ে থাকা একটা আধলা ইট কিশোর সজোরে বসিয়ে দিল অমিয়র মাথায়।

সঞ্জয় ভট্টাচার্য

[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *