[:bn] ঘুড়ি ঘুড়ি[:]

[:bn] ঘুড়ি ঘুড়ি[:]

January 14, 2018

[:bn]বিভিন্ন শহর আর শহরতলীতে সরস্বতী পুজোর সময়, খোদ কলকাতা শহরে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আকাশ ছেয়ে যায় ‘পতঙ্গ’ আর ‘ ঘুড়িতে’ ।  ঠিক মনে হয় ঝকঝকে নীল সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে হাজারো রঙের উরন্ত নৌকা—এ  ওকে তাড়া করছে, ও এর গায়ে গিয়ে পড়েছে, ফড়ফড় করে টেনে এক ঘুড়ির সুতো কেটে দিচ্ছে অন্য্  ঘুড়ির সুতো।’কাটি  পতঙ্গ’ ভেসে চলেছে একের পর এক, নিচে উন্মত্ত শিশু – কিশোর জনতা পাগলের মত গলা ফাটাচ্ছে’ ভোকাট্টা’  — গুজরাটে  সেই আওয়াজটাই  পাল্টে  গিয়ে হচ্ছে ‘কায়  পোচে’।  ঘুড়ি  – সন্ধানী  শিশুর সংগ্রাহকের দল  লগি  হাতে ছুটছে সেই  ভোকাটা ঘুড়ি দখলে আনতে। মেয়েদের যেমন স্বরসতী পূজার শাড়ি পড়ে বড়ো সাজার  উৎসব ,স্কুলে আর  বাড়িতে বাড়িতে ঠাকুরের জন্য বিভিন্ন রংয়ের কাগজের  শিকলি  বানানো আর  আলপনা দেবার উৎসব, বাচ্চা ছেলেদের কাছে তেমনি কতক্ষণে ঘুড়ি লাটাই নিয়ে মাঠে গিয়ে হাজির হবে  তার উচ্ছ্বসিত প্রতীক্ষার উৎসব|সরস্বতী পুজোর সময় মাঠে মাঠে লাটাই হাতে ছেলেদের ঘুড়ি কাটার  প্রতিযোগিতা আর  আকাশ নানারঙের ঘুড়িতে ছেয়ে যাওয়ার পরিচিত ছবিটার  কথা বললাম বলে মনে কর না, এটা শুধু বাঙ্গালীদের উৎসব, গোটা ভারত বর্ষ জুড়ে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব চলে—- দিল্লি ,হায়দ্রাবাদ ,আমেদাবাদ ,বিহার  সর্বত্র।

 

আমাদের পশ্চিমবঙ্গেই বরং ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব বলে কোনো বিশেষ উৎসব নেই ,অন্যান্য কোনো কোনো রাজ্যেশুধু ঘুড়ি ওড়ানো নিয়েই উৎসব চলে, এর জন্য রাজ্য সরকার ছুটিও ঘোষণা করেন। সবচেয়ে ঘটা করে এই উৎসবে গুজরাতে। সেখানে প্রায় ২০০ বছর ধরে উৎসব চলে আসছে , এই উৎসবটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘উত্তরায়ণ’। রাজ্য সরকারের দু দিন ছুটিও থাকে এই উৎসব পালনের জন্য। ভারতবর্ষের বাইরে চীন ,জাপান , প্রভৃতি দেশে এই উৎসব খুবই জনপ্রিয়। প্রায় প্রত্যেকটি উৎসবের সঙ্গে ধর্মের একটা যোগাযোগ আছে।
পশ্চিমবঙ্গে বিশ্বকর্মা হচ্ছেন সমস্ত কলকব্জার দেবতা ,কাজেই ঘুড়ি তারই সৃষ্টি বলে মনে করা হয়। তবে কলকাতার বাবু কালচারের যে সব বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে বাবুদের নানারকম বিলাস-বুলবুলির লড়াই, পায়রার প্রদর্শনী, প্রচুর টাকা খরচ করে পুতুলের বিয়ে,এইরকমই একটা শখ ছিল ঘুড়ি ওড়ানো।কোন বাবুর ঘুড়িকে বেকায়দায় ফেলতে পারে কোন বাবুর ঘুড়ি। কলকাতার এই সময়কার কালচার নিয়ে ভারি মজার একটা বই আছে-দু খন্ডে ‘হুতুম প্যাঁচার নকশা’, সেখানে সরস্বতী পুজোর কথা বলা আছে ,কিন্তু ঘুড়ি ওড়ানোর কথা নেই – এদিকে সরস্বতী পুজো হয়ে গেল।ঢাকঢোল বেজে উঠলো। ছেলেরা নৈবিদ্দির ধারে দাঁড়িয়ে স্বচন্দন ফুল বিল্লপত্র নিয়ে স্বরস্বতীই নমো নিত্যং বলে অঞ্জলি দিলে। ফুল কানে গুঁজে বিড়খণ্ডী ও কুল খেলে।…

 

গুরুম করে একটার তোপ পড়লো’ । কাজেই মনে হয় , বিশেষ একটা পূজা উপলক্ষে ঘুড়ির রেষারেষি তখনও শুরু হয়নি।তবে গুজরাতে এই উৎসব শুরু হতো মকর সংক্রান্তির দিন । প্রকৃতির দিক থেকে তখন শীত কেটে বসন্ত আসছে, চাষের মরশুম শুরু হচ্ছে ।ধর্মীয় দিক থেকে মনে করা হতো দেবতারা তখন দীর্ঘ নিদ্রা থেকে জেগে উঠেছেন – তাঁদের আমোদ -প্রমোদের জন্যই এই উৎসব।
এসব তো গেল ধর্মীয় বা আমোদ উপকরণের কথা, কিন্তু ঘুড়ি নামক একটা আশ্চর্য পদার্থ বানাবার মতলবটাই মানুষের মাথায় কখন এলো, কেমন করে এলো! বাতাসের চেয়ে ভারী একটা জিনিসের বুকে একটা পাতলা কঞ্চি সেঁটে দাও , চওড়া – চওড়ি আর একটা বড় কঞ্চি মাথার দিকে বেঁকিয়ে লাগাও– সুতো ধরে টানলেই সেটা বাঁই -বাঁই করে ওপরের দিকে উঠবে। মজার ব্যাপার নয়?
ঘুড়ি ওড়াবার কথাটা মানুষের মাথায় কেমন করে এলো, সেটা বোঝা মোটেই শক্ত নয়। ঘুড়ি ওড়ানো আর বেলুন ওড়ানো দুটোরই ভেতরের কথা আসলে এক ।সেই ভেতরের কতটা জানতে পাবে সুকুমার রায়ের ‘ফানুস’ রচনায়— ‘মানুষ অনেক কাল হতেই চায় পাখির মতো আকাশে উড়তে।…. পাখির নকল করে বড় বড় ডানা বানিয়ে তার সাহায্যে উড়ে বেড়াবার চেষ্টা অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। হাতে পিঠে ডানা লাগিয়ে লোকে সাহস করে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়েছে — আর তাতে কতজনের প্রাণ গিয়েছে’। ঘুড়ি ওড়ানো আর বেলুন ওড়ানোর মূল উদ্দেশ্যটা যে একই ,এটা সুকুমার রায়ের বাবা ‘ বাবা গুপি গাইন ও বাঘা বাইন’ এর লেখক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বেশ কয়েকটি রচনায় বুঝায় বলেছেন, যদিও দুটো জিনিস আকাশে উড়বার কায়েদা আলাদা– গরম হলেই বাতাস হালকা হয়ে যায়, সেই বাতাস ঠেলে উঠতে চায় ওপরে,হল বেলুন ভাসাবার রহস্য। কিন্তু দুটির পেছনেই মানুষের উদ্দেশ্য একই।

 

সে না হয় হল, কিন্তু ঘুড়ি তৈরি করাটা শুরু হল কবে থেকে? যদি দেশে-বিদেশের প্রাচীন লোককথার গল্প ধরো তাহলে তো আর থই পাবে না, বরং তার আগে আমাদের জানাশোনা ঘটনাগুলোর কথাই আগে ধরা যাক। আমেরিকার বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের তোমরা অনেকেই শুনেছ । তাঁর ধারণা হয়েছিল বজ্রগর্ভ মেঘে থাকে পজিটিভ আর নেগেটিভ দু ধরনের তড়িৎ । সেটার প্রমান পাবার জন্য এটি ১৭৫২ সালে তৈরি করে ফেললেন সত্তিকারের একটা ঘুড়ি। ঝড়ের মেঘে সেই ঘুড়ি উড়িয়ে পেয়ে গেলেন তড়িৎ।
এতে যদি আশ্চর্য হয়ে থাকো তাহলে এর চেয়ে বড় একটা আশ্চর্যের কথা শোনো পঞ্চদশ শতাব্দীর বিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বানিয়ে ফেলেছিলেন ঘুড়ি ,আর সেই ঘুড়ি উড়িয়ে দারুন কাজ করেছিলেন তিনি একটা –নায়েগ্রা ফলসের ওপর থেকে সমুদ্রের গভীরতা মাপার চেষ্টা করেছিলেন। কেমন করে এটা করেছিলেন সে কথা এখন থাক, তার চেয়ে অবাক হবার মত একটা কথা শোনো । আজকের দিনের বিজ্ঞানীরা মনে করেন, তিনি যেসব নকশা এবং অন্যান্য জিনিস উদ্ভাবন করেছিলেন তার থেকেই পরবর্তী কালে আমরা পেয়েছি প্যারাসুট আর হেলিকাপ্টার।

 

এরপর ধরো উনিশ শতক থেকে অনেক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেই ঘুড়িকে কাজে লাগানো হয়েছে। বিশ শতকে সেটা বেশি কাজে লেগেছে সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ বিগ্রহের ক্ষেত্রে। আকাশটাকে সুন্দরভাবে সাজানোর জন্য ঘুড়ি যে ব্যবহার করা হয়, সে কথা না হয় ছেড়েই দিলাম।
লোককথা আর পৌরাণিক গল্পে কতকাল যে ঘুড়ি উড়ছে আর ঘুড়ি অসাধ্য সাধন করেছে একথা না বলাই ভালো। শুধু আমাদের দেশে বলে নয়, জাপান,ইন্দোনেশিয়া ,এসব দেশের গল্পেও ঘুড়ি বারবার দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে চিনে বোধহয় এসব গল্প সবচেয়ে পুরোনো কালের । যুদ্ধবিগ্রহের প্রাচীন চীন গল্পেও ঘুড়ি উড়েছে অনেকবার । চীনের এক অত্যাচারী রাজার হাত থেকে বাঁচার জন্য বিদ্রোহী সৈন্যদল ঘুড়ি উড়িয়ে রাজার সৈন্যদের অবস্থান জেনে নিয়ে তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল এবং সেই রাজার অপশাসন শেষ হয়েছিল। চীনের কথা যখন উঠলই তখন বলি , একেবারে প্রথম ঘুড়ির যে উল্লেখ পাওয়া যায় তা তৈরি হয়েছিল প্রায় তিন হাজার বছর আগে ওই চিনেই ,আর সেটা তৈরি হয়েছিল বাখারি এবং পশম দিয়ে। আকার ছিল তার বিশাল, আমাদের ঢাউস কথা মনে আছে তো?

 

টেনিদার যে গল্প ‘ডি লা গ্রান্ডি মেফিস্টোফিলিস ইয়াক ইয়াক ‘বলে শুরু হয়েছিল, সেখানে যে ঘুড়ি দেখা গিয়েছিল তার চেয়েও অনেক অনেক বড়। চিনে এবং অন্যান্য কয়েক জায়গায় অবশ্য এখনও বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন জীবজন্তুর আদলে বানানো ঘুড়ি দেখা যায়।মানে নানা রঙের হলেও আমাদের প্রায় চারচৌকো ঘুড়ি দেখা যায় তার বদলে নানা আকৃতির ঘুড়ি সেসব জায়গায় দেখা যায়। চিনে তো ড্রাগনও প্রধান ,তাই ড্রাগন আকৃতির ঘুড়ি তো সেখানে থাকবেই ।
তবে আমাদের এখানে ঘুড়ি ওড়ানোয় অনেক পরিবর্তন এসেছে।আমরা ঘুড়ি উড়াতাম,রঙ অনুযায়ী তাদের কত নাম — চাপরাশ,মুখপোড়া , চাঁদিয়াল,চোরঙ্গী, বাঁশমার ,পেটকাট্টি , আরও কত কি।সুতোয় মাঞ্জা দেবার জন্য আঠার সঙ্গে কাঁচের গুড়ো মিশিয়ে লেই করা হতো, তারপর মাঠে বাঁশ পুঁতে ঘুরে ঘুরে তাদের মাঞ্জা দেওয়া।কাগজ জলে ছিঁড়ে যাবে বলে ফাইবার গ্লাসের পটে এখন ঘুড়ি তৈরি হচ্ছে। সুতোর ব্যবহার উঠতে চলেছে, কেমিক্যাল সুতো ঘুড়ি ওড়ালে তার কাটার সম্ভবনা কম ।
তবে যাই বলো ,ঘন্টার পর ঘন্টা মাঞ্জা তৈরি করা, সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া,এখানে ওখানে ছিঁড়লে পাতলা কাগজ দিয়ে তা জোড়া আর সবচেয়ে বড় কথা ওই সম্মিলিত চিৎকার —‘দুয়ো,দুয়ো’,ভো —–কাট্টা ‘এই যেন ছিল ভালো । তোমরা কি বল?

 

     হিরেন চট্টোপাধ্যায়

[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *