[:bn]চাঁদে কেন গ্রহণ হয়[:]

[:bn]চাঁদে কেন গ্রহণ হয়[:]

July 24, 2018

[:bn]তারকনাথ রুদ্র
এক ছিল বুড়ি। তার ছিল দুই নাতি। রোগশয্যায় শুয়ে-শুয়ে একদিন বুড়ি বুঝতে পারল, তার দিন শেষ হয়ে এসেছে। তাই সে তার নাতি দুটিকে বিছানার পাশে ডেকে বলল, দাদুভায়েরা, আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। মরবার সময় তোমাদের কিছু একটা দিয়ে যেতে চাই। কিন্তু আমার তো সোনাদানা বা রুপোর কিছু নেই। কেবল থাকবার মধ্যে আছে রান্নাঘরে একটা খল আর একটা নুড়ি। খলটি নেবে আমার বড়ো নাতি আর নুড়িটি নেবে আমার ছোট নাতি।
এই বলে বুড়ি মরে গেল।
বড় ভায়ের ছিল খুব বাস্তব বুদ্ধি। সে মনে মনে চিন্তা করল, খল নিয়ে আর আমি কী করব? আমি কি রাঁধুনি হয়ে কারো রান্নাঘরে চাকরি করব, আর খলের সাহায্যে মশলা করব। এটা আমার কোনো কাজেই লাগবে না।
এই ভেবে যে খলটি ফেলে রেখে অন্য দেশে কাজের সন্ধানে চলে গেল।
ছোটো ভাই তার ঠাকুরমাকে ভীষণ ভালোবাসত। তাই ঠাকুরমার প্রতিটি কথাতেই ছিল তার অটুট বিশ্বাস। সে ভাবল, নুড়িটির নিশ্চয় কোনো না কোনো গুণ আছে। গুণ না থাকলে ঠাকুরমা তাকে সেটি দেবেই বা কেন? আর এতদিন ধরে সেটিকে নিজের কাছে যত্ন করে রাখবেই বা কেন!
এই ভেবে সেটিকে সে একটি মূল্যবান সম্পদের মতো অতি যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিল।
সামান্য একটা নুড়িকে এইভাবে যত্ন করে রাখার জন্যে গাঁয়ের লোকেরা তাকে নানা সময়ে নানাভাবে উপহাস করত। কিন্তু ছোটো ভাই তাতে কিছু মনে করত না। সকলের সঙ্গে যেমন সে গাঁয়ে ছিল, তেমনিই থেকে গেল। কোথাও যাওয়ার কথা চিন্তা করল না। বনের থেকে শুকনো জ্বালানি কাঠ কেটে নিয়ে এসে বাজারে বিক্রি করে কোনোরকমে দিন চালাত।
কেউ কখনো তার নুড়িটিতে হাত দিলে সে হায় হায় করে উঠত। পাড়ার লোকেরা বলত, তোমার এই সামান্য নুড়িটিকে নিয়ে কি কেউ পালিয়ে যাচ্ছে যে তুমি অমন আর্তনাদ করছ?
শুনে কোনো উত্তর দিত না ছো্টো ভাই। খালি মুখ টিপে হাসত।
একদিন বনে কাঠ কাটতে গেছে ছোটো ভাই, হঠাৎ প্রকাণ্ড এক সাপ দেখে ভয়ানক ভয় পেয়ে গেল সে। প্রাণ বাঁচাতে তাড়াতাড়ি একটা গাছে উঠে পড়ল।
সাপটা সেই গাছের কাছে এসে অবিকল মানুষের গলায় বলল, আমার দেখে ভয় পেয়ো না। আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না। তোমার কাছে এসেছি একটি প্রার্থনা নিয়ে। আমার একটি উপকার করতে হবে।
সাপকে মানুষের গলায় কথা বলতে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেছিল ছোটো ভাই। ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছিল সে তখন বটে; তবু কোনোরকমে সাহসে ভর করে বলল, আমার দ্বারা তোমার কী উপকার হবে ভাই?
সাপ বলল, এইমাত্র আমার স্বামী মারা গেছে। আমি কিছুক্ষণের জন্যে তোমার নুড়িটি ধার চাই। একটু পরেই ফিরিয়ে দেব।
ছোটো ভায়ের ছিল নুড়ি-অন্ত প্রাণ। কিন্তু নুড়িটির কোনো গুণ আছে বলে সে জানত না। তাই জিগ্যেস করল, নুড়িটি তোমার কী উপকারে লাগবে?
সাপ বলল, তুমি জানো না; তোমার নুড়িটির একটি অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। কেউ মারা গেলে এই নুড়িটি তাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে। তুমি যদি নুড়িটি নিয়ে আমার সঙ্গে যাও তো তোমাকে দেখিয়ে দিতে পারি কী করে এটিকে ব্যবহার করতে হয়।
তখন সেই সাপের কথায় বিশ্বাস করে ছোটো ভাই গাছ থেকে নেমে নুড়িটি নিয়ে সাপের পিছু পিছু গেল। সাপটি ধীরে ধীরে প্রবেশ করল এক গভীর জঙ্গলে। ছোটো ভাইও সেখানে গিয়ে দেখল, সত্যি সত্যি এক বিশাল আকারের সাপ মরে পড়ে রয়েছে।
সাপিনী তখন ছেলেটির হাত থেকে নিজের ফণায় করে নুড়িটি নিয়ে সেই মৃত সাপটির নাকের কাছে ধরল। দেখতে দেখতে প্রাণ ফিরে পেল সেই সাপ।
তখন সাপিনী সেই নুড়িটি ছোটো ভাইকে ফিরিয়ে দিয়ে বললে, এই নুড়ির আশ্চর্য ক্ষমতা দেখলে তো? এর মধ্যে এমন এক গন্ধ আছে, যা বাইরে থেকে কেউ পাবে না। কিন্তু মৃত প্রাণীর নাকে একবার এই গন্ধ গেলে সঙ্গে সঙ্গে সে বেঁচে উঠবে। তবে তুমি যতদিন একথা সকলের কাছে গোপন রাখবে, ততদিন এর ক্ষমতা থাকবে অটুট। লোক জানাজানি হয়ে গেলে সে ক্ষমতা চলে যাবে।
ভীষণ অবাক হয়ে ছোটো ভাই নুড়িটি নিয়ে জঙ্গলের মধ্য থেকে তার গ্রামের পথে ফিরতে লাগল।
এক সময় এক জায়গায় সে দেখতে পেল পথের ওপর একটা মরা কুকুর পড়ে রয়েছে। নুড়িটির সত্যি সত্যি কোনো অলৌকিক গুণ আছে কিনা জানার আগ্রহ হল তার। কৌতুহলী হয়ে সে নুড়িটি যেই মরা কুকুরটার নাকের সামনে কিছুক্ষণ ধরল, অমনি কুকুরটা বেঁচে উঠে লেজ নাড়তে নাড়তে তার চারপাশে ঘুরতে লাগল। বাড়ির দিকে ছোটো ভাই রওনা দিলে সেও তার পিছু পিছু চলতে লাগল।
ধীরে ধীরে সেই কুকুর ছোটো ভাইয়ের বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে উঠল। আদর করে ছোটো ভাই তার নাম রাখল পচা।
দেখতে দেখতে ছেলেটির নাম দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ল। এমন চিকিৎসক এর আগে কেউ কোথাও দেখেনি, যে কিনা মরা মানুষ বাঁচাতে পারে। তাই দূর-দূরান্ত থেকে তার যেমন ডাক আসতে লাগল, তেমনি খ্যাতি এবং প্রতিপত্তিরও কোনো সীমা-পরিসীমা থাকল না। কিন্তু কীভাবে সে যে মরা মানুষকে বাঁচাত তা কেউ বুঝতে পারত না। নুড়িটি সব সময় তার হাতে থাকত। নুড়ির কোনো গুণ থাকতে পারে তা কেউ ধারণাই করতে পারত না। সবাই জানত ঠাকুরমাকে খুব ভালোবাসত বলে তার দানটি সে কাজ ছাড়া করতে চায় না। ছোটো ভাই নুড়ির আশ্চর্য অলৌকিক ক্ষমতার কথা কাউকে বলত না।
এইভাবে দিন যেতে যেতে একবার সেই দেশের রাজার একমাত্র মেয়ের হল কঠিন অসুখ। কিছুতেই আর সারে না। সমস্ত রাজবৈদ্য একে একে ফিরে গেল। কেউ রোগ সারাতে পারল না। তারপর সেই অসুখেই একদিন মারা গেল রাজকন্যা।
রাজা সেই ছোটো ভাইয়ের অলৌকিক ক্ষমতার কথা শুনেছিলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলে তার কাছে। সমস্ত শুনে নুড়িটি নিয়ে ছোটো ভাই রাজবাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হল। তারপর রাজকন্যার নাকের কাছে নুড়িটি তুলে ধরে বাঁচিয়ে তুলল রাজকন্যাকে।
দারুণ খুশি হলেন রাজা। তিনি এই ছোটো ভাইয়ের সঙ্গেই তাঁর একমাত্র কন্যার বিয়ে দিয়ে দিলেন। এইভাবে ঠাকুরমার আশীর্বাদে নুড়ির গুণে ছোটো ভাই সামান্য কাঠুরিয়া থেকে একেবারে যুবরাজে পরিণত হয়ে গেল। রাজকন্যার সঙ্গে পেল অর্ধেক রাজত্বও।
যুবরাজ হয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছে ছোটো ভাই। হঠাৎ একদিন তার মাথায় হাজির হল এক অদ্ভুত চিন্তা। সে ভাবল, নুড়িটির গন্ধ যদি মরা মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে, তাহলে নিশ্চয় সেই গন্ধ মানুষকেও বুড়ো হতে দেবে না।
যেমনি ভাবা, অমনি সে রোজ একবার করে নুড়িটিকে নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকতে লাগল। তার স্ত্রীকেও শোঁকাতে লাগল।
এইভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটে যেতে লাগল। ছোটো ভাই দেখল, সকলেই কেমন আস্তে আস্তে বয়স্ক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের বয়স বাড়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। তখন সে বুঝতে পারল এই নুড়িটির আর একটি ক্ষমতাও রয়েছে। এ অনন্ত যৌবন দিতে পারে।
এদিকে ছোটো ভাইয়ের এই কান্ড দেখে দারুণ হিংসা হল আকাশের চাঁদের। একমাত্র চাঁদই হচ্ছে অনন্ত যৌবনের অধিকারী। আর সবার থেকে সুন্দর সে। কিন্তু মর্ত্যের মানুষ যে এমন অনন্ত যৌবনের অধিকারী হবে, এটা কোনোমতেই সহ্য হচ্ছিল না তার।
চাঁদ তাই মনে মনে ঠিক করল, যেমন করেই হোক ছোটো ভাইয়ের ঐ নুড়িটি সে চুরি করে নিয়ে চলে আসবে।
তক্কে তক্কে থাকে চাঁদ। কিন্তু ছোটো ভাই সব সময় নুড়িটিকে এমন চোখে চোখে রাখে যে চাঁদ কোনোমতেই সুবিধে করতে পারে না।
সেবার কয়েকদিন ধরে বর্ষা নামল আকাশে। অনবরত বৃষ্টি হতে থাকল। একেবারের জন্যই বিরাম নেই। ছোটো ভাই একদিন দেখল, সেই স্যাঁতসেঁতে বাদলা আবহাওয়ায় নুড়িটি তার কেমন ভিজে ভিজে হয়ে গেছে। তাই ভাবল রোদ উঠলে সেটিকে রোদে দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে।
বাদলা কেটে গিয়ে আকাশ আবার ঝরঝরে পরিষ্কার হয়ে যেতে, চারিদিক রোদের আলোয় ঝলমল করে উঠতে রাজবাড়ির উঠোনের এক জায়গায় ছোটো ভাই তার নুড়িটিকে রোদে দিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে লাগল।
এদিকে চাঁদও আকাশ থেকে লক্ষ করছিল সবকিছু। ভাবছিল নুড়িটি চুরি করবার এই চমৎকার সুযোগ। কিন্তু ছোটো ভাই মুহূর্তের জন্যও নুড়িটির দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাচ্ছিল না বলে চাঁদ তেমন সুযোগ পাচ্ছিল না।
এমন সময় রাজকন্যা সেদিক দিয়ে যেতে যেতে দেখতে পেল ছোটো ভাইয়ের কান্ড। সামান্য একটা নুড়ির জন্যে তার স্বামীকে রোদে এ-ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার ভারী খারাপ লাগল। রাজকন্যা ছো্টো ভাইয়ের কাছে গিয়ে বলল, ‘তুমি হলে যুবরাজ। তুমি এ-ভাবে রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? ও নুড়িটি যদি অতই মূল্যবান বলে মনে কর, তাহলে রাজবাড়ির যে কোনো দাসদাসীকে তার পাহারায় বসিয়ে দাও।’
কিন্তু ছোটো ভাই কোনো কথা শুনতে নারাজ। বলে, ‘আমার নুড়ি কেউ পাহারা দিতে পারবে না।’
কিন্তু রাজকুমারীর পীড়াপীড়িতে অবশেষে ছোটো ভাইকে রাজি হতে হল। বলল, ‘ঠিক আছে, তবে আমার বিশ্বস্ত কুকুর পচাকে ডেকে দাও। পচা ছাড়া আমি আর কাউকে বিশ্বাস করি না।’
রাজকন্যা তার দাসীকে দিয়ে পচাকে ডেকে আনতে ছোটো ভাই তাকে পাহারার কাজে লাগিয়ে চলে গেল।
চাঁদ এইরকমই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সে সূর্যের আলোতে গা- ঢাকা দিয়ে চুপি চুপি নেমে এল আকাশ থেকে। পচা তাকে দেখতে পেল না। তবে বুঝতে পারল কে যেন আসছে। তাই সে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। কিন্তু চোখে কিছু দেখতে পেল না বলে কাউকে বাধা দিতে পারল না। চাঁদ অতি সহজেই নুড়িটি চুরি করে নিয়ে আকাশে উঠে গেল। আর পচাও নুড়ির গন্ধ শুঁকে শুঁকে চাঁদকে তাড়া করে যেতে লাগল।
সেইভাবে আজও চাঁদকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে পচা। মাঝে মাঝে যখন চাঁদকে সে ধরে ফেলে তখনই চন্দ্রগ্রহণ হয়।[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Latest Blog

  • বাই বাই একাকিত্ব

    April 1, 2019 Read more
  • সহস্র হ্রদের দেশঃ ফিনল্যান্ড

    March 28, 2019 Read more
  • পথের পাঁচালি ও ভাগলপুরের বাঙালি সমাজ

    March 28, 2019 Read more
View All

Contact Us

(033) 23504294

rajika.mazumdar@gmail.com

21, Jhamapukur Lane, Kolkata - 700 009.

Book Shop

View All