[:bn]জগন্নাথদেবের অন্যতম সেবা —চিত্রপট [:]

[:bn]জগন্নাথদেবের অন্যতম সেবা —চিত্রপট [:]

March 6, 2018

[:bn]স্নান যাত্রার পর মুর্তি বিহীন মন্দিরে হাজার হাজার দর্শনার্থী ছুটে আসে কাকে দেখতে !মূর্তি তো তখন থাকে মন্দির প্রাঙ্গনের উচুঁ বেদিতে। যে জায়গাটাকে বলা হয় ‘আনন্দবাজার’। মন্দির থেকে মহাসমারোহে তিন দারুমূর্তিকে আনা হয় মহাস্নান করানোর জন্য। জ্যেষ্ঠ পূর্ণিমার পূণ্য তিথিতে তাঁর জন্মদিন।বিভিন্ন পুরাণ ও শাস্ত্রে এই তিথিটি জগন্নাথ দেবের জন্মদিন বলে স্বীকৃত। অবশ্য স্নান তিনি রোজই করেন। এটা দৈনন্দিন পূজার একটা অঙ্গ। যা হয় মন্দিরের অভ্যন্তরে লোকচক্ষুর আড়ালে। উৎসবের মাধ্যমে তা আজ হয় প্রকাশ্যে– শুধু ভক্তদের আনন্দ বর্ধনের জন্য।কিন্তু ভক্তের কাছে ভগবান বড় আপন,নিজের লোকের মতো, তাই নিত্যশুদ্ধ হয়েও ভগবানকে স্নান করানো হয়–ভোজন করানো হয়, আবার শয়নও।   এ সবেরই একটা অন্তর্নিহিত কারণে আছে, যে কারণে নবরূপে আবির্ভূত ঈশ্বরের জন্ম, বিবাহ,বার্ধক্য,মৃত্যু– সবই হয়। অর্থাৎ

এ যেন তাঁর ‘আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখায়’,

মহাজনো যেন গতঃ সঃ পন্থাঃ’,

তাই তাঁকেও পালন করতে হয়েছে চতুরাশ্রম।সাধারণ মানুষ স্নান করে দেহশুদ্ধি করে,পরমাত্মা মহাস্নান-এর মধ্য দিয়ে শিক্ষা দিলেন– শুধু দেহশুদ্ধি নয়, মনের মলিনতাও  দূর করতে হবে। সব কলুষতা ধুয়ে ফেলতে হবে, তবেই মুক্তি। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য–এই ষড়রিপু  বশীভূত মানুষ দেবতার কাছে আসতে পারে না। তাই দেহ-মন ধৌত করে তাকে পুন্য পবিত্র হতে হয়। আর সেই হবার জন্যই এই স্নানযাত্রা।

কিন্তু যে প্রশ্নটা প্রথমেই উঠেছিল সেটা হল দারুমূর্তি না থাকলেও ভক্তের দল ছুটে যাচ্ছে কি দেখতে, আর দর্শন করে এতটা তৃপ্তই বা হচ্ছেন কি করে,এটা কি শুধুই স্থান মাহাত্ম্য নাকি অন্য কিছুও রয়েছে। এটা জানতে গেলে ‘নীলাদ্রি মহোদয়া’ ও বিখ্যাত গ্রন্থ

‘মাদলাপঞ্জী’র সাহায্য নিতে হবে।

রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে সঙ্গে ব্রহ্মর এক কথোপকথন হয়। রাজা ব্রম্ভাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্নানযাত্রার পর জগন্নাথ দেবের এই ১৫ দিনের অদর্শন কেমন করে সহ্য করবেন তিনি এবং অসংখ্য ভক্তের দল। তাদের সে যন্ত্রনা কি করে লাঘব হবে। ব্রম্ভা বললেন যেহেতু জগন্নাথ দেবের নির্দেশেই মন্দিরের দরজা যে ক’টাদিন বন্ধ থাকবে–সে সময় দরজার বাইরে একটা বাঁশের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হবে। স্নানযাত্রার পর ওই চালচিত্র একটি সুন্দর সূক্ষ্মবস্ত্রের দ্বারা আবৃত থাকবে। তার ওপর তিনটি কাপড় থাকবে।ওই তিনটি কাপড়ের ওপর আঁকা হবে তিন বিগ্রহ– জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার ছবি। এটাই হলো পটচিত্র। এবার ওই পটচিত্রই তিন বিগ্রহের স্থান গ্রহণ করে মন্দিরে থাকবেন। এই চিত্রপটকে বলা হয় ‘অনবসর’ বা ‘অনসর পট’।  পট মানে হলো পট্টবস্ত্র। যেমন পুরি মানে হল গৃহ,পুরি হল জগন্নাথ দেবের গৃহ। দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণে লাগে মাটি, ধাতু, প্রস্তর,কাঠ,চন্দন, রত্ন,ফুল। এগুলি দিয়ে চিত্রপটও নির্মাণ করা হয়।অনসর পটে বলরামের চিত্র হয় শ্বেতবর্ণ,তাঁর চার হাত। তাতে ধরা রয়েছে শঙ্খ, চক্র, হল ও মুষল । পরনে রাজবেশ ,রাজ আভরণ।

দ্বিতীয় পটে সুভদ্রাকে দেখি রাজ রাজেশ্বরী ভুবনেশ্বরী দেবী রূপে। তাঁর গাত্রবর্ণ হলুদ। তিনি এখানে পদ্মাসীনা, তাঁরও চার হাত। উপরের দুই হাতে পদ্ম,নীচের দুই হাতে বরাভয় মুদ্রা।

তৃতীয় পটে জগন্নাথ বসে আছেন পদ্মাসনে। চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম। চোখ দুটি গোলাকার। গায়ের রং ঘন নীল,বুকে  চিহ্নিত শ্রীবৎস চিহ্ন,কৌস্তব মনি ,গলায় বনমালা।  এই পটগুলিতেই পনেরো দিন ধরে পূজা চলে। ব্রম্ভা বলেছিলেন, এই পটগুলির মধ্যেই স্বয়ং জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা অবস্থান করবেন। হিন্দু মতে পট বা ঘটই হল দেবতার প্রতিভূ। এই বিশ্বাস নিয়েই হাজার হাজার দর্শনার্থী পুরীর মন্দিরে আসেন, পূজো দেন ও পূর্ণ শান্তি নিয়ে ফিরে যান।

আমরা জানি জগন্নাথ-বলরাম ছিলেন শবর জাতির আরাধ্য দেবতা। শবররাজ বিশ্ববসু নিজেই পুজো করতেন তার নীল মাধবকে। লীলা প্রচারের জন্য নীলমাধব স্বপ্নাদেশ দিলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে। রাজা দূত হিসেবে ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতিকে। কিন্তু শবররাজ বিদ্যাপতিকে নীলমাধবের  গুপ্ত স্থান দেখাতে চাইলেন না। তখন শর্ত হলো বিদ্যাপতি যদি তাঁর কন্যা ললিতাকে বিবাহ করেন তবেই নীলমাধবের সন্ধান তিনি দেবেন। বিদ্যাপতির ব্রাহ্মণ সন্তানরা হলেন এক প্রজন্ম। অন্য প্রজন্ম হল শবর পত্নীর সন্তানরা। এই দুই  প্রজন্মই মন্দিরের দেবতা জগন্নাথ- দেবের আপন লোক। তাই তাদের জগন্নাথের সমস্ত কাজকর্মের অর্থাৎ ক্রিয়াকর্মের ওপর রইল পূর্ণ অধিকার। জগন্নাথ দেবের আচার-বিচার খাদ্য প্রকরণ, সাজসজ্জা, রীতিনীতি–সবই শবর সমাজকেন্দ্রিক হয়ে উঠল। এদের মধ্যেই গড়ে উঠল পটচিত্রকর। যে পট তিন বিগ্রহে রূপদান করেছে পটের মাধ্যমে ।

‘মাদলাপঞ্জী’ —— আগেই বলেছি উড়িষ্যার এক বিখ্যাত গ্রন্থ ,যার মধ্য দেব জগন্নাথের  মন্দিরের নিয়ম-কানন,প্রথা সব কিছুই উললেখ করা আছে। একটি প্রথা আছে নিয়োগ প্রথা বা নিয়োগ প্রথা। যার মানে হল ‘সেবা’। এই ‘সেবা  তিন প্রকার ।

১) চিত্রকর সেবা ২) রূপকার সেবা ৩) শ্রীমুখশৃঙ্গারী সেবা। চিত্রকর সেবার অন্তর্গত হল পটচিত্রকরগণ। জানা যায় পুরি থেকে কটকের মধ্যে আরও তিন প্রকার চিত্রকরের গড় বা ঘর আছে। যাদের তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে।

১) আঠারো ঘর চিত্রকর। যারা শুধু জগন্নাথদেবের চিত্রপট তৈরী করেন।

২)  চৌদ্দঘর চিত্রকর–এরা কেবলমাত্র বলরামের চিত্রপট তৈরি করে।

৩) ছয়ঘর চিত্রকররা দেবি সুভদ্রার পটছবি তৈরি করে।

এদের মধ্যে ১৮ ঘর ও ১৪ ঘরের শিল্পীদের জগন্নাথদেবের আশীর্বাদধন্য বলা হয়। কারণ এদের মৃত্যুর পর এদের চিতা জ্বালানো হয় জগন্নাথ দেবের মন্দিরের মহাভোগ রন্ধন করার জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে।

বলা চলে জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রার নির্দেশে পর যখন ১৫ দি তাঁকে ভক্তদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখা হয় তখনই তাঁর প্রতিভু রূপে আবির্ভাব হয়েছিল পটচিত্রকরদের।

ড.গৌরী দে

[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *