[:bn]নিভে গেছে ধুপ তবু ……[:]

[:bn]নিভে গেছে ধুপ তবু ……[:]

March 22, 2018

[:bn]

 বিষয়বস্তু : সন্তানহারা পিতামাতার ব্যাথা

বিদিশা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে সাত মাস হয়ে গেল। সে আমাদের মেয়ে। হ্যাঁ ,একমাত্র মেয়ে ছিল। আসলে, মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য সামান্যতম সুযোগ আমরা পাইনি। আর এই সুযোগটুকু না পাওয়ার জন্য বিদিশার মা প্রতিটা মুহূর্তে আপসোস করে,অঝোর ধারায় চোখের জল ফেলে ঠাকুরঘরে ঢুকে উন্মত্তের মতো চিৎকার করে প্রায়শই বলে ওঠে ‘ঠাকুর ,কেড়েই যখন নেবে মেয়েটাকে দিয়েছিলে কেন ?’ বোলো আমাদের কী অপরাধ ছিল ?  নাকি  আমার মেয়েটা কোনো অপরাধ করেছিল ?’

এইরকম সময় আমি ওকে স্বান্তনা দিয়ে বলি, ‘আঃ আর কত কান্নাকাটি করবে অনিমা ? এই পৃথিবীতে যার যতটুকু আয়ু সে তো ততটুকুই বাঁচবে। তোমার আর আমার ইচ্ছায় কি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চলবে ?’
আসলে আমি অনিমার সামনে খুব শক্ত আর কঠিন থাকার অভিনয় করি। কিন্তু আদতে আমি ওর থেকে অনেক অনেক বেশি দুর্বল।ভাঙাচোরা যন্ত্রণা আর কাতর মন নিয়ে তাই মাঝে মাঝে ভাবি অনিমার হাত ধরে অনেক দূরে কোথাও চলে যাই, যেখানে আমাদের মেয়ে বিদিশার ফেলে যাওয়া কোন স্মৃতিচিহ্ন থাকবে না। কারণ, যে অসহনীয় কষ্টে আর তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় আমরা সবসময় ছটফট করছি তা আরও অনেক বেড়ে যায় বিদিশার ছবি, ফেলে যাওয়া অগণিত টেডি বিয়ার আর পোশাক-পরিচ্ছদ গুলো দেখে। কতবার অনিমাকে বলেছি,’ছবিগুলো না হয় থাক কিন্তু মেয়ের ব্যবহার করা খেলনা -পুতুল, জামা কাপড় গুলো অন্তত একটু আড়ালে রাখো। আমাদেরও তো বাঁচতে হবে।’ এ কথার উত্তরে অনিমা বলে মেয়ের ব্যবহার করা জিনিসপত্রে তো আমি ওর শরীরের গন্ধ পাই, ওর স্পর্শ পাই। তুমি পাও না ? অনিমার প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি না। বলা ভালো দিতে চাই না। শুধু ওর থেকে দূরে সরে গিয়ে দু -চার ফোটা চোখের জল ফেলে আসি নিঃশব্দে।
বিদিশা কোনদিন পাহাড় দেখেনি। তাই একদিন আমি অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই সে আমার কোলের কাছে বসে বলল, বাবা আমাদের ভূগোল বইয়ে যত রাজ্যের পাহাড়-পর্বতের বিবরণ রয়েছে। অথচ আমি নিজের চোখে সেসব কিছুই দেখলাম না। চলো না, আমাকে শিলং পাহাড় দেখাবে।
মেয়ের আবদার শুনে আমি মৃদু হেসে বলেছিলাম, ‘ধুর পাগলী, এ বছর তো তোর মাধ্যমিক পরীক্ষা। ঘুরতে যাওয়ার সময় কোথায় এখন ? তার চেয়ে বরং…..’
আমার কথা শেষ না হতেই মেয়ে অনুযোগের সুরে বলেছিল, ‘থাক, যেতে হবে না। তোমাদের ইচ্ছে না থাকলে আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে হবে না। আমি শুধু ঘরে বসে পড়াশোনা করব। মাধ্যমিকের সিলেবাসেও যে পাহাড়-পর্বতের বিবরণ আছে তা তো তুমি শুনতেই পেলে না।’
মেয়ের আহত মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ওর মাথায় হাত রেখে বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে মা, নেক্সট মান্থে তুই , তোর মা আর আমি শিলং পাহাড়ে যাচ্ছি।’ আমার কথা শুনে বিদিশার হাসির ছটায় সেদিন চারপাশটা কেমন যেন আলোকময় হয়ে উঠেছিল। আনন্দ আর হাসিতে ভরে উঠেছিল ওর সমস্ত মুখ।
শিলং যাবার জন্য শিলং আমাদের প্রস্তুতি শেষ। হাজার রকমের বাধা পেরিয়ে ট্রেনের তিনটি টিকিট কনফার্মও হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিলাম,গুয়াহাটি গিয়ে আগে মা কামাখ্যার মন্দিরে পূজা দেব। তারপর ওখান থেকে শিলং যাব। বিদিশার তো ফুর্তি আর ধরে না। দীর্ঘদিন পর বেড়াতে যাব বলে অনিমাও বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ছিল।
সেদিন ভোর থেকেই অঝোরধারায় বৃষ্টি পরছে। সকালবেলায় বিদিশা টিউশন পড়তে যেতে পারেনি। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম অফিসে যাব না।জাস্ট ‘রেইনি ডে ‘ উপভোগ করব। কিন্তু বাদ সাধল বিদিশা। স্কুলে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে এসে আমাকে বলল, ‘বাবা, আজ বাংলা প্রজেক্ট -এর খাতা জমা দিতেই হবে। কারণ আমরা তো পরশুদিনই শিলং চলে যাচ্ছি। কাল সানডে। তাছাড়া একটু আগেই তনুশ্রী, বিনিতারাও ফোন করে বললো, ওরা স্কুলে যাবে আজ।’
প্রথমে আমি মৃদু আপত্তি করলেও মেয়ের প্রয়োজন বুঝে শেষমেশ বললাম, ‘এই বৃষ্টিতে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়াটা খুব রিস্কি হয়ে যাবে। যেতেই যখন হবে আজ তুই বরং রিক্সা বা অটো ধরে স্কুলে যা।
আমার প্রস্তাব নস্যাৎ করে দিয়ে বিদিশা বলল, ‘ধুর বাবা, কি চিন্তা কর ! রেইনকোট পড়ে আমি ঠিক আস্তে আস্তে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতে পারব। রিক্সা, অটো ধরতে গেলে আমার হয়ত আজ স্কুলে যাওয়াই হবে না। অনেক লেট হয়ে যাবে।
বিদিশার কথা বলার ভাব দেখে সেদিন বুঝেছিলাম, আমার মেয়ে সত্যিই বড় হচ্ছে।
মর্মান্তিক খবরটা এলো বিকেল সাড়ে চারটেয়। আমারই বন্ধু অনিমেষ ফোন করে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, ‘শিগগির এ.বি রোডের মোড়টাতে চলে আয়। বিদিশার এক্সিডেন্ট হয়েছে।’
অনিমেষকে আর কোন প্রশ্ন করিনি। মুহূর্তেই ফোনটা কেটে দিয়ে আমি অনিমাকে কিছু না জানিয়ে মুষলধারে বৃষ্টির ভেতর এক প্রকার দৌড়োতে দৌড়োতেই পৌঁছে গেলাম এ.বি রোডের মোড়ে। দূর থেকেই দেখি লোকে লোকারণ্য। বুঝলাম সব শেষ তবে ! আর নেই আমাদের মেয়ে বিদিশা। হ্যাঁ ,সত্যিই আর ছিল না আমাদের বিদিশা। স্পট ডেথ , প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাল ,স্কুল থেকে সাইকেল চালিয়ে ফেরার সময় পিছন থেকে ট্রাক এসে ওকে…
মেয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে অনিমা জ্ঞান হারিয়েছিল। সেই জ্ঞান ফিরলেও শরীর আর মনের দিক থেকে অসার হয়েছিল ও। যার রেশ এখনও আছে। বাড়ি-ঘর ময় আমাদের একমাত্র মেয়ে বিদিশার অজস্র স্মৃতিচিহ্ন, অনিমার চোখের জল আর শিলং যাওয়ার টিকিট তিনটে নিয়ে আমিও আজ বেঁচে আছি নিষ্প্রাণ পাথরের মতো।

সঞ্জয় কর্মকার

[সোহিনী সরকার স্মৃতি -সাহিত্য প্রতিযোগিতার ২য় পুরস্কৃত গল্প ]

[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *