[:bn]বাংলা ক্যালেন্ডারের গল্প[:]

[:bn]বাংলা ক্যালেন্ডারের গল্প[:]

July 18, 2018

[:bn]শৈলেন চক্রবর্তী

শুভ নববর্ষ। বলতে গিয়ে ঠোঁটের কোনায় এসে যায় ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’। মোবাইলে মেসেজ করতে গিয়েও তাই লিখে ফেলি। আসলে প্রতিদিনের তারিখ বলতে ইংরেজি ক্যালেন্ডারটাই মাথার মধ্যে ঘোরে। নতুন বছর বলতেই আজকাল ‘পয়লা জানুয়ারি’ ধাঁ করে করে সামনে চলে আসে। বাংলাতেও যে আস্ত একটা ক্যালেন্ডার আছে, তা খেয়ালই থাকে না।

এক্ষুনি কি বলতে পারব, আজ বাংলা কত তারিখ? এটা বাংলা ক্যালেন্ডারের কোন মাস? মনে মনে  হিসেব করতে হয়, এই রে পয়লা বৈশাখ মানে কত তারিখ? মাকে জিগ্যেস করে দেখি তো? মাও ঢোক গিলে বলেন, দাঁড়া বাবা, দেখে বলছি চোদ্দ না পনেরোই এপ্রিল কবে যেন!

অনেক বাড়িতেই বাংলা ক্যালেন্ডার নেই। থাকে না। আর থাকলেও সে ঝুলে থাকে ঠাকুরঘরের দেয়ালে। একাদশী-পূর্ণিমা তিথি খুঁজতে মাঝে মাঝে তার পাতা ওল্টানো হয়। ব্যস। ‘নববর্ষ’ মানে নতুন বছর। বাংলায় আর একটি নতুন বছর শুরু হল। ১৪২১ সন। পয়লা বৈশাখ হল মঙ্গলবার, পূর্ণিমা তিথি। ওমা এই দেখো, পনেরোই এপ্রিল লেখা রয়েছে বাংলা নববর্ষ, ১ বৈশাখ।

অথচ আমাদের দেশে বৈশাখ আছে সেই আদ্যিকাল থেকে। এপ্রিল এসেছে অনেক পরে। ইংরেজরা বগলদাবা করে ইংরেজি ক্যালেন্ডার নিয়ে এসেছিল ভারতবর্ষে। এই আধুনিক ইংরেজি ক্যালেন্ডারকে সারা পৃথিবীতেই বলে ‘গ্রেগরিয়ন ক্যালেন্ডার’। খ্রিস্টান পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে এই আধুনিক ক্যালেন্ডার সংস্কার করেছিলেন।

 

‘সংস্কার’  বললাম কেন?

ক্যালেন্ডার তো একদিনে তৈরি হয়নি। সেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষ নানাভাবে সময়ের হিসেব করত। সূর্য উঠলে ‘দিন’ হয়, সূর্য ডুবলে ‘রাত’। আবার সূর্য ওঠা-ডোবার ও সময় বদলে যায়। কখনও সূর্য আগে ওঠে, কখনও পরে। দিন বড়ো, কখনও দিন ছোট। দিন- রাত সমান ও হয়। আবার পূর্নিমা-অমাবস্যা হয়। কখনও  ভরা জোছনা, কখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার। কত কী যে ঘটে ওই আকাশে। কখনও খুব রোদ, কখনও শীত। আবার কখন ও ঝমাঝম বৃষ্টি। সময়কে ধরে ধরে মানুষ নানান হিসেব কষতে থাকল। ঘুরেফিরে এল বছর, মাস, সপ্তাহ। এভাবেই ধীরে ধীরে ক্যালেন্ডার তৈরি হল। অনেক জটিল কঠিন হিসেব।

বাপরে বাপ, শুভ নববর্ষ বলতে গিয়ে এতরকম হিসেব। না না, আর হিসেব-টিসেব করব না। কেবল ক্যালেন্ডারের ভেতর কত যে লুকোনো গল্প আছে সেগুলো জেনে নেব। ভালো লাগবে, দেখো। জুলিয়াস সিজারকে চেনো তো? রোমের বিখ্যাত বীর। সে অনেকদিন আগেকার কথা। তখনও যিশু খ্রিস্টের জন্ম হয়নি। তার মানে ‘খ্রিস্টাব্দ’ শুরু হয়নি। সে- সময়টাকে হিসেব করা হয় ‘খ্রিস্টপূর্ব’ বলে। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্যালেন্ডার তৈরি হয়েছিল চাঁদ দেখে। চাঁদকে বলে চন্দ্র। তাই ওই ক্যালেন্ডারকে বলা হত চান্দ্র ক্যালেন্ডার। আর সেই ক্যালেন্ডারে ৩৫৫ দিনে এক বছর হত। আর বছরে ছিল মোট দশটা মাস। কিন্তু চাঁদের হিসেবে তো আর ঋতু পরিবর্তন হয় না। শীত- বসন্ত- গ্রীষ্ম- বর্ষা এসব হল সূর্যের কারবার। তাই রোমের মানুষজন, মানে রোমানরা তাদের ক্যালেন্ডারে ঋতু পরিবর্তনকে ঠিকমতো ধরতে পারত না। কী করবে তাহলে?

জুলিয়াস সিজার প্রথম বললেন, মানুষের জীবনের সঙ্গে চাঁদের বিশেষ যোগাযোগ নেই। মানুষের জীবনে বরং সূর্য খুব দামি। সূর্য না থাকলে জীবন অচল। সূর্যের জন্যই শীত- গ্রীষ্ম- বর্ষা- শরৎ।  সে সময় জুলিয়াস আবার মিশর অভিযান করলেন। রাজা- রাজাড়ারা তখন নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অন্য রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে সেই রাজ্য জয় করতে চাইতেন। তো, মিশরে গিয়ে জুলিয়াস দেখলেন,ক্যালেন্ডারে এক বছর হয় ৩৬৫ দিনে। আর সেই ক্যালেন্ডারটা তৈরি হয়েছে সূর্যকে ধরে। এই ক্যালেন্ডার হল ‘সৌর ক্যালেন্ডার’।

আসলে সৌর ক্যালেন্ডারে ১ বছরের দৈর্ঘ্য ছিল ৩৬৫১/৪ দিন। অথচ বছর গোনা হচ্ছে ৩৬৫ দিনে। তাহলেই ওই ১/৪ দিন, মানে ৬ ঘন্টা সময়টা যাবে কোথায়? জুলিয়াস বললেন, চার বছর পরে একটা বছর গোনো ৩৬৬ দিনে। ওই বছর ফেব্রুয়ারি মাসটা হবে ২৮ দিনের বদলে ২৯ দিনে। ক্যালেন্ডার নিয়ে জুলিয়াস সিজারের এই সংস্কার হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে।

জুলিয়াসের অনেক পরে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি  ক্যালেন্ডারের হিসেবকে আরও  নিখুঁত করলেন। তিনি বললেন, চার বছর অন্তর একটি বছর ৩৬৬ দিনের হোক। কিন্তু শতাব্দী শেষের বছরগুলো হোক ৩৬৫ দিনের। মানে ১৭০০, ১৮০০, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের বছরগুলোতে ৩৬৫ দিন থাকবে। আবার ৪০০ দিয়ে ভাগ করলে মিলিয়ে যায়, সেই বছরগুলো হবে ৩৬৬ দিন। তাই ২০০০ সালে ছিল ৩৬৬ দিন। আবার ২৪০০ সালও হবে ৩৬৬ দিন। মাঝে ২১০০, ২২০০, ২৩০০ সাল হবে ৩৬৫ দিনের।

এই ক্যালেন্ডারই এখ্ন সারা পৃথিবীর ক্যালেন্ডার। একেই আমরা বলি ‘গ্রেগরিয়ন ক্যালেন্ডার’। মুখে মুখে ইংরেজি ক্যালেন্ডার। ইংরেজরা আমাদের দেশে আসবার আগে ভারতবর্ষের ক্যালেন্ডার কেমন ছিল? সেটা হল আমাদের বাংলা ক্যালেন্ডার। ‘হিন্দু ক্যালেন্ডার’ বলাই ভালো। ৫০০-৬০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারতে সূর্য- চাঁদ- নক্ষত্র নিয়ে বেশ কৌতুহল শুরু হয়। এ নিয়ে একটা বই লেখা হল ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’। সূর্যই আমাদের জীবনের প্রধান শক্তি। বাংলায় ক্যালেন্ডার এবং পঞ্জিকা তৈরি হত এই সূর্যসিদ্ধান্ত মতে। পঞ্জিকা হল ‘পাঁজি’। বিয়ে- পেতে-অন্নপ্রাশনের দিন ঠিক করতে পাঁজি দেখা হয়। পুজোর দিনও ঠিক হয় পাঁজি দেখে। প্রতিবছর কিন্তু একই দিনে দুর্গাপূজো, কালীপুজো হয় না, খেয়াল করেছো?

 

কেন এরকম হয়?

‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ বইয়ে সময় ও বছরের হিসেবটা খুব নিখুঁত, কিন্তু জটিল। বলবে, আবার সেই হিসেব। না, জটিল হিসেবে আমরা যাব না। শুধু এটুকু বলব, বাংলা ক্যালেন্ডার খুব নিখুঁত এবং খাঁটি ক্যালেন্ডার। একেবারে নিখুঁত অঙ্ক। ইংরেজি ক্যালেন্ডার থেকে আমাদের ক্যালেন্ডার অনেক এগিয়ে। কিন্তু তার ব্যবহার আজ কমে গেছে। তবু আজও বাঙালির জীবনের পবিত্র ও গভীর যে কোনো কাজে বাংলা ক্যালেন্ডারই ভরসা।

বাংলা ক্যালেন্ডারে সূর্য ছাড়াও থাকে আকাশের নানা গ্রহ-নক্ষত্র। রাতের আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল, কালপুরুষ, ধ্রুবতারা এসব দেখি তো। এইসব তারা ও গ্রহগুলির সঙ্গে সূর্যের সম্পর্ক আছে। আমরা জানি, সূর্য স্থির। পৃথিবী ঘুরছে। তাই পৃথিবী থেকে সূর্যের অবস্থান বছরের নানা সময় বদলে বদলে যায়। মনে হয় যেন সূর্যই তার গতিপথ বদলে ফেলছে। সূর্যের এই মনে হওয়া গতিপথকে বলে ‘রবিপথ’। সূর্যের আর এক নাম ‘রবি’। এই রবিপথের মধ্যে রয়েছে বারোটা নক্ষত্রমন্ডল। এগুলোকে বলে ‘রাশি’। নক্ষত্রমন্ডল মানে একগুচ্ছ তারা। বারোটা রাশি হলো মেষ, বৃষ, মিথু্‌ন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা,  বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ, মীন। সব-মিলিয়ে বলে ‘রাশিচক্র’। বারোটি রাশি দিয়ে ঘেরা একটি  চক্রাকার পথে যেন সূর্য ঘুরে চলেছে।

মেষ রাশিতে যেদিন সূর্য এসে ঢোকে, সেদিন শুরু হয় বৈশাখ মাস। পয়লা বৈশাখ বাংলা বছরের শুরু। সূর্য বৃষ রাশিতে এলে জ্যৈষ্ঠ মাস শুরু। তেমনি মিথুন রাশিতে আষাঢ় মাস, কর্কট রাশিতে শ্রাবণ মাস, সিংহ রাশিতে ভাদ্র, কন্যায় আশ্বিন, তুলায় কার্তিক, বৃশ্চিকে অগ্রহায়ণ, ধনুতে পৌষ, মকরে মাঘ, কুম্ভে ফাল্গুন, আর মীন রাশিতে চৈত্র মাসের শুরু। তারপর আবার মেষ রাশিতে পরের বছর বৈশাখ মাস। এই যে বললে, কোন তারামণ্ডলীর কাছে সূর্য রয়েছে, তা দেখেই ঠিক হয় সূর্য কোন রাশিতে রয়েছে, কোন মাস শুরু হবে বাংলা ক্যালেন্ডারে। কিন্তু সূর্য তো দেখি দিনের বেলায়, আর তারা দেখি রাত্রে। তাহলে কেমন করে মেলাব সূর্যের সঙ্গে তারাকে?

সূর্য অস্ত গেলেই আকাশে একটু একটু করে তারাদের দেখা যায়। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে গেল বিকেলবেলা। তখনই পুব আকাশে তাকিয়ে দেখো, কোন তারা দেখা যাচ্ছে। আর একটি তারা চিনতে পারলেই রাশিচক্রের বাকি তারা-মণ্ডলীগুলিকে ঠিক চিনে নেওয়া যায়।

সূর্য ডোবার সময় আকাশে যদি দেখি কুম্ভ রাশির তারা, তাহলে বুঝব সূর্যের ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে কুম্ভ রাশি। আর রাশিচক্রে কুম্ভের বিপরীতে থাকে সিংহ। তার মানে সূর্য তখন সিংহ রাশিতে রয়েছেন। পাঁজিতে বাংলা ক্যালেন্ডারে তখন ভাদ্র মাস।

কী, মজা লাগছে না ? বলবে, রাশিচক্র কেমন করে চিনব, নক্ষত্রমণ্ডলীকে কীভাবে দেখব, কেমন করে তিথি দেখব, বলে দাও তো। উঁহু, সবকিছু একদিনে হবেনা। বাংলা ক্যালেন্ডারকে, পঞ্জিকাকে, তিথি- নক্ষত্র রাশিচক্রকে যদি সত্যি সত্যিই আরও ভাল করে চিনতে চাও, তাহলে শুকতারাকে চিঠি লিখে জানাও। আর পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষে বাংলা ক্যালেন্ডারটাকে ভালোবেসে খুঁটিয়ে দেখো। তারপর না হয় আর একদিন গল্প করব।

বল তো, এবছর কবে দুর্গাপুজো ? সন্ধিপুজো কখন ? কবে কখন দেবীর বিসর্জন ? সব মা বলে দেবেন, কিংবা পুরুতমশাই বলে দেবেন, তা কিন্তু হবে না। ক্যালেন্ডারকে চিনে দেখে নিজেদের বলতে হবে। পুরো ক্যালেন্ডারটাই খুব মজার অঙ্ক । বাংলা ক্যালেন্ডার আর পঞ্জিকার জগতে একবার ঢুকে পড়তে পারলে মজা টের পাবে।

এবছর ১৪২১ সনে বাংলা নববর্ষ শুরু হচ্ছে ১৫ এপ্রিল। আর পঁচিশে বৈশাখ ৯মে, শুক্রবার। রবি ঠাকুরের জন্ম ১২৬৮ সনের ২৫ বৈশাখ। সেদিন ছিল হাজার ১৮৬১ সালের ৬ মে । আর সে বছর পয়লা বৈশাখ ছিল ১২ এপ্রিল । এ বছর তারিখগুলো এগিয়ে গেলো কি করে ! মটে তো দেড়শ বছর কেটেছে । জানো কি, আজ থেকে চৌদ্দোশো বছর পরে পয়লা বৈশাখ হবে ৮ মে । বলো তো , সে বছর ২৫ শে বৈশাখ , ইংরেজি কত তারিখ হবে ?

ওহ , আবার সেই হিসেবে ![:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *