[:bn]বাস্তব[:]

[:bn]বাস্তব[:]

March 8, 2018

[:bn]দোলন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল বরেনের দিকে। মানুষটাকে চেনাই যায় না। অমন দশাসই চেহারা শুকিয়ে কতটুকু হয়ে গেছে। কাঁচা হলুদের মত গায়ের রং পুড়ে কালো হয়ে গেছে।একভাবে পড়ে আছে। হাজার ডাকেও সাড়া দেয় না। প্রাণটুকু আছে এই যা।

দোলন  বরেনের কপালে হাত দিল। তারপরই চমকে মুখের দিকে তাকালো। না, একই ভাব। তবু কেন যে ও গায়ে হাত দিলেই মনে হয় বরেন সাড়া দিল! দীর্ঘনিঃশ্বাস বুকে চেপে বরেনের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ওর ইচ্ছে করে বরেনের বুকের কাছে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়তে।বরাবর তো তাই পড়ত । দোলনের ছোটোখাটো চেহারা। রংটাও চাপা।তাই নিয়ে দোলন কিছু বললে বরেন হাসতো। বলতো, আমার বুকের মধ্যে তোমায় লুকিয়ে রাখব, কেউ দেখতে পাবে না। কথাটা মিথ্যে নয় ওই দশাসই চেহারার মধ্যে কোথায় যে হারিয়ে যেত দোলন !

চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে দোলনের । বাড়িতে এখন কেউ নেই। ছোট ছেলে কলেজে। বড় ছেলে কোথায় যেন বেরিয়েছে। বাবা যে বাঁচবে না তা ওরা জানে। বড়ো ছেলে বাড়ি এসে একটাই কথা জিজ্ঞেস করে। দোলন মাথা নাড়ে। ছেলে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকে যায়। ওই মুহূর্তে দোলনের বুকটা যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। নিজেকে ভিসন অপরাধী মনে হয়। আর কেউ না জানুক, ও তো জানে বরেন ওকে কতটা ভালোবাসে। আর ওই দুই ছেলে।ওরা তো বরেনের চোখের মনি। ছেলেদের শখ বজায় রাখতে কোনদিন কার্পণ্য করেনি বরেন।নিজে একজন স্কুল টিচার।কতই বা মাইনে! তবু কোন বিষয়ে ক্রুটি ছিল না ওর। ভালো পড়াতো। শিক্ষক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম ছিল।ইচ্ছে করলেই টিউশানি করে অনেক টাকা করতে পারতো বরেন ।কিন্তু কোনো প্রলোভনেই পা দেয়নি। ছাত্রদের পড়ার উল্টে বিনাপয়সায় মেধাবী ছাত্রদের পড়াতো।ছাত্ররা অনেকেই এখন জীবনে সু-প্রতিষ্ঠিত। কেউ কেউ বিদেশে আছে। দেশে ফিরলে স্যারের সঙ্গে দেখা করে যায়।

সাধারণ ঘরের মেয়ে দোলন।বেশি স্বপ্ন দেখেনি।দুই ছেলে আর স্বামী কে নিয়ে সুখেই ছিল।অভাব আছে। হা-হুতাশ নেই। বিয়ের পর স্বামীকে দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল দোলনের। কি সুন্দরই না দেখতে! ঠিক যেন রাজপুত্তুর। গোড়ার দিকে নিজেকে হেয়-জ্ঞান করত। কিন্তু বরেনের আদর ভালবাসায় তার মনের সব জড়তা কেটে গিয়েছিলো। বড় ছেলে জন্ম নেওয়ার পর তো সে পুরোপুরি গৃহিণী।

দোলন তাকালো বরেনের মুখের দিকে। দাঁড়ি – গোঁফে মুখটা  ঢেকে গেছে। সেই জঙ্গল ভেদ করে নাক দিয়ে নল চলে গেছে পেটে। নেজাল ফিডিং চলছে। লোকটা কি খেতে ভালোই না বাসতো ! আর আজ !

সত্যিই কি ও আর কোনদিন ভালো হবে না?  ডাক্তারবাবু তো বলেই গেছেন, কোনো আশা নেই। যে কোনোদিন ও শেষ হয়ে যাবে। এখন নাকি ও

ডিপ কোমায় আছে। বোধ নেই, জ্ঞান নেই। দোলন বরেনের মুখের দিকে তাকায়।কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে আসতে আসতে ডাকে। যদি সাড়া  দেয়। আশায় আশায় তাকায়। হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বরেনের মুখটা ভালো করে দেখতে ইচ্ছে করে। দাড়ি- গোঁফের জন্য  বরেনকে  চেনাই যায় না। বড় ছেলেকে কতবার বলেছে।কানেই তোলে না কথাটা। অথচ অসুখের গোড়ার দিকে সে নিয়ম করে বাবার দাড়ি কামিয়ে দিত। সেবা করতো।

সেদিনের পর কি যে হলো, বাবার ঘরে আর উঁকিও দেয় না। বাড়ি ফিরে ঐ একটাই প্রশ্ন।ও কি বোঝে না– এই প্রশ্নটা করে ও ওর মাকে কতো কষ্ট দেয়। ওর তো বাবা। কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে।কম আদর দিয়েছে! দোলনের আপত্তি সত্বেও বড় ছেলের সব আবদার রাখততো বরেন।

খরচ করে ফেলতো একগোছা টাকা।তাই নিয়ে মাসের শেষে কি কম কষ্ট পেত!

আজকাল আবার কি এক নতুন হিসেব কষে। সকলকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, আর দশ দিন! কি দশ দিন,কিসের দশ দিন! দোলন কতবার জানতে চেয়েচে। ছেলে উত্তর দেয়নি। জিজ্ঞেস করে ছেলে উঠে চলে গিয়েছিলো। দোলনের মাথায় বড়কুর কথাটা ঘোরে।দোলন জানে কাল সকালে বড়কু  নির্ঘাত বলবে আর ন’ দিন।কিসের হিসেবে কে জানে ! দোলনের মাথায় ঢোকে না। মাথা থেকে ঝেড়ে মুছে ফেলতেও পারে না।ও  এইটুকু বোঝে ,বড়কুড় এই হিসেবে তার বাবাকে নিয়েই।আয়ু নিয়ে নয় তো?

তবে কি আর মাত্র  ন’দিন বাঁচবে বরেন ? কথাটা মনে হতেই দোলনের বুকটা মোচর দিয়ে উঠল।কি রকম যেন খালি হয়ে গেলো বুকটা।দুঃখ-কষ্ট সব হারানোর ব্যথা গলে গলে চোখ বেয়ে নামতে লাগল। দোলন দুহাত দিয়ে বরেনের মাথাটা বুকে চেপে ধরতে গিয়ে থমকে গেল,নেজাল ফিডিংয়ের নলটা  ওকে যেন বরেনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ওর মনটা হাহাকার করে ওঠে। চোখের জল সামলাতে সামলাতে দোলন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ।

দুপুর যে কখন গড়িয়ে গেছে দোলন টের পাইনি। ছোট ছেলে ফেরায় হুশ হলো। অথচ এই সময়ে স্কুল থেকে ফিরে বাড়ি মাথায় তুলতো বরেণ। কোথায় বড়কু ,ছোটকু , কোথায় গেলি…… চেঁচিয়ে জানান দিত সকলকে–আমি আছি, আমরা  থাকবো।

মায়ের চোখের জল দেখে থমকে গিয়েছিলো ছোটকু। আজকাল ভয় পেয়ে আছে সে। পথে হরিধ্ধনি শুনলেই কেঁপে ওঠে ভয়ে। ভয়ে, আতঙ্কে ওর শরীর হিম হয়ে যায়।আজকাল কলেজের সময়টুকু ছাড়া ও বাড়ির বাইরে থাকে না।ও দেখেছে একা থাকলেই মা বসে বসে কাঁদে।দাদাটা যে কি হয়েছে ! একটুও বাড়ি থাকতে পারেনা? সারাদিন ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথায় যায়, কি করে,– কে জানে।

মায়ের চোখের জল দেখেই  ছোটকু আতঙ্কিত গলায় ডাকলো, মা ? কিরে? কাঁদছো কেন? না, এমনি! বাবা? ওই একই রকম।

বই -খাতা রাখতে গিয়ে ছোটকু ঘরে গিয়ে ঢোকে। বাবার দিকে একবার তাকিয়েই ছিটকে বেরিয়ে আসে। বাবার ওই অবস্থা ও সহ্য করতে পারে না। মার চোখে জল, বাবার ওই অবস্থা ওকে বিহবল করে তোলে। এই তো সেদিনও ও বাবার কোলে চড়ে ঘুরত। সময় বড়ো তাড়াতাড়ি কেটে যায়।স্কুলের গন্ডি ডিঙিয়ে এখন ও কলেজে। নিজেরই অবাক লাগে।

ওকে এভাবে বেরিয়ে আসতে দেখে চমকে তাকিয়েছিল দোলন। একটা আশঙ্কায়, আতঙ্ক সব সময় কাঁটা হয়ে থাকে। মাকে চমকে উঠতে দেখে ছটকু বলল, বাবাকে ওইভাবে দেখতে ভালো লাগে না মা।

ছেলের সামনে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে দোলন। চাপা গলায় বলে, খাবি চল।সে কোন সকালে দুটি ভাত মুখে দিয়ে কলেজে গিয়েছিলি। তুমি খেয়েছ? না খেলে কি আর পোড়া পেট মানে ! মা, বাবা ভালো হবেনা?

দোলনের বুকের মধ্যে উথাল-পাতাল করে। ও ভালভাবেই জানে বরেণ আর ভালো হবে না।ওইটুকু ছেলের সামনে কী সে কথা বলা যায়।.আস্তে আস্তে বলে কি জানি ? ঘড়ির কাঁটার হাত ধরে সময় কেটে যায়। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে। রাতের সঙ্গে তাল দিয়ে বারে আতঙ্ক। ঘুমতে পারে না।।এক ভয় ওকে আঁকড়ে ধরে।ও বুক ভরে দম নিতে পারেনা। ছেলেরা অন্য ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে,দোলন তখন বরেনের পাশে একা।বরেন এখনও পাশে আছে। বেশিদিন থাকবে না। কথাটা মনে হতেই হু হু করে কেঁদে ওঠে। ও একা, ভীষণ একা।

পরদিন সকালে উঠে মুখ চোখ ধুয়ে গালে হাত দিয়ে বারান্দায় বসে ছিল দোলন। ছেলেরা যতক্ষণ না ওঠে ও চুপচাপ বসে আছে।আগে তো ব্যাস্ততার অন্ত ছিলনা। এতক্ষণ বরেনের কাপ দুয়েক চা  খাওয়া হয়ে যেত। রান্না চাপাতে হত তাড়াতাড়ি।বরেনের স্কুল বেশ খানিকটা দূরে। সাড়ে আটটার মধ্যে খেতে বসত বরেন। দম ফেলার সময় পেত না দোলন। এর মধ্যে  দুই ছেলের স্কুলের তাড়া।

আর  আজ ! কোন তাড়া নেই।বড়কু গত বছর বি.এ পাস করেছে। এখনও কাজ পায়নি। রোজ নাকি কাজের ধান্ধায় ঘোরে।দোলন বুঝতে পারে ছেলেটার মধ্যে আস্তে আস্তে একটা পরিবর্তন আসছে।হতাশ হয়ে পড়ছে। ওর বাবা  সান্ত্বনা দিত।বলতো , অত ভাবিসনে  একটা কিছু হয়েই যাবে। না হলে আমাদের স্কুল তো আছে। বলে-কয়ে যা হোক একটা ব্যবস্থা আমি করে ফেলব।

বাবা অসুস্থ হবার পর বড়কুই দু মাস মাইনে আনতে যাচ্ছে। চাকরির কথা বলছে কিন্তু–

বড়কু যে কখন উঠে এসেছে দোলন বুঝতে পারেনি। হঠাৎ বড়কু নিজের মনে বলে উঠলো, আর ন’ দিন ! চমকে উঠল দোলন। কী বলতে চায় বড়কু রোজ কেন ও দিন গোনে।

হঠাৎ দোলনের  মাথায় আগুন জ্বলে উঠে। লাফিয়ে উঠে গিয়ে ও বড়কুর হাত চেপে ধরে।হিসহিস করে বলে, আজ তোকে বলতেই হবে, কেন তুই  রোজ সকালে দিন গুনিস ! মার উগ্র মূর্তি দেখে ঘাবড়ে যায় বড়কু।কথা ঘোরাবার জন্য বলে, ও কিছু না মা…..ও কিছু না…। কিছু না মানে? আজ তোকে বলতেই হবে।। না,মা,না  তুমি…

তুমি  কি– বল কেন তুই রোজ  সকালে দিন গুনিস!

শুনবে,শুনবে সে কথা  সহ্য করতে পারবে?

পারবো, পারবো– সব সহ্য করতে পারবো।

দোলনের গলা  ধরে আসে।

আর ন’দিন পড়ে বাবা রিটায়ার করবে। এই ন’দিনের মধ্যে বাবা চলে গেলেওই জায়গায় আমি চাকরিটা পাব।

বড়কুর কথা শুনে দোলনের বুকের ভিতরটা হিম হয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ছেলের মুখের দিকে।

শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়

[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *