[:bn]বিয়ের আগে ও পরে : চাঁদের দুই পিঠ [:]

[:bn]বিয়ের আগে ও পরে : চাঁদের দুই পিঠ [:]

February 22, 2018

[:bn]

চাঁদ নিজের অক্ষরেখায় এমনভাবে ঘুরতে থাকে ঘুরতে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে যাতে সূর্যের আলো সর্বদাই তার এক পিঠে পড়ে, আর অন্য পিঠ চির – অন্ধকার,রহস্যাবৃত ,সেদিকের কোন খবরই আমরা জানি না । ‘রক্তকরবী’ নাটকের বিশু পাগল বলেছিলেন, চাঁদের পিঠে আলো পড়ে না, আমি সেই দিক । সে হয়তো বলতে চাই, আলোকিত দিক হল রঞ্জন, নন্দিনীকে যে কেবল নন্দিতই করে, বিশুর মতো দুঃখ দেয় না। উপমাটা আমাদের খুব বেশি মনে পড়ে ছেলে-মেয়েদের প্রাক-বিবাহ প্রেম পর্ব এবং পরিণয়োত্তর জীবনের তফাৎটা মনে করে। সব সময় হয়তো নয়, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রাক-বিবাহ দীর্ঘ প্রেমপর্বে মেয়েটি যে ছেলেটিকে দেখছে ,চিনছে ,ভালোবাসছে , পদাতিক প্রেমে বা লেকের ধারে স্পর্শবিহ্বল প্রেমে ছেলেটি যে মেয়েকে নিয়ে অভিভূত রোমাঞ্চিত বা স্বপ্নবিভোর হচ্ছে, বিবাহের অল্পদিনের মধ্যেই সে যেন হারিয়ে যাচ্ছে। পূর্ণ চাঁদের মায়া অপসৃত হয়ে বিবাহোত্তর জীবনে যেন নির্বাসন ঘটেছে তাদের উল্টো পিঠে, যে অন্ধকার জগতের সঙ্গে কোনো পরিচয় ছিল না তার ।মনে পড়ে যায় একটি জনপ্রিয় বাংলা ছবিতে গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের একটি অবিস্মরণীয় গান,: ‘জানিনা আজ যে আপন কাল সে কেন পর হয়ে যায়,
যে বাতাস ফোটাল ফুল সে -ই তো আবার ঝড় হয়ে যায় ।’
যে মধুগন্ধী বাতাস একদিন প্রেমের কোমল কুঁড়ি কে পুষ্পিত করেছিল, পরবর্তীকালে সেই বাতাসই ঝড় হয়ে সমস্ত সম্পর্ক ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে আসে কেন? অথচ তাই যে আসে , এর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।
দৃষ্টান্ত এক
অন্যান্য দিন দেরি হলেও ক্ষতি নেই, বুধবারটা মিতুলের তাড়াতাড়ি যেতে দিতেই হবে, কলেজের ওর ভীষণ তাড়া। কিন্তু ওর বন্ধুরা জানে কলেজে আসার ব্যাপারে মিতুল পাংচুয়াল হলেও কোন বুধবারই। ওকে কলেজে পাওয়া যাবে না। ও বাড়ি থেকে বেরোবার আগেই বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে অঞ্জন। ছেলে ভালো অঞ্জন ,বি.কমে দারুণ রেজাল্ট করে কম্পিটিটিভ পরীক্ষার জন্য খাটছে, কিন্তু বুধবারটা ওর পুরোপুরি অফ,এটা মিতুলের সঙ্গে যতক্ষণ পারে কাটাবার দিন। বাড়ি থেকে হাতে- পাতে করে আসে দুজনেই, তারপর সারাটা দিন তো পড়েই আছে। কোথায় যাবে কোন ঠিক নেই, কোন দিন নলবন , কোন দিন অন্য কোথাও, কিন্তু কোন সিনেমা হলের বদ্ধ ঘরে বসে সময় কাটাবে না, খোলা পার্কে বড় বড় রাস্তায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের প্রাঙ্গণে বসে শুধু গল্প ,গল্পের আর শেষ নেই। বুধবারটা মিতুলের জন্মদিন, সেজন্য ওই দিনটাকেই বেছে নিয়েছে ওরা ঘুরে বেড়াবার জন্য। নিভৃত নির্জন চায় না ওরা, শারীরিক ঘনিষ্ঠতার কথা ওরা ভাবে না,অঞ্জন তো নয়ই । মিতুলের হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় ধরে রেখে অনর্গল গল্প করে যেতে পারলেই ও খুশি । সত্যিকারের জন্মদিনটা যেদিন আসে,অঞ্জন বলে রেখেছে , সেই বুধবারটা বিশেষ ভাবে উদযাপন করার জন্য মঙ্গলবার রাতে দেরি করে খায় , রাত বারোটার সময় বাড়ির সমস্ত আলো জ্বেলে দেয়, ঠিক বর্ষশেষের ৩১ ডিসেম্বরের মতো — পরের বছরের প্রথম দিনটিকে সে বরণ করে নেবে। তারপরই মিতুলকে ফোন করে জন্মদিনের জন্য উইশ করবে।
চলে এসেছে এই রকমই বরাবর, এবং বিয়ের পরও বছর দুয়েক এই ব্যাপারটা ছিল। তারপরই সেটা একটা রিচুয়াল হয়ে এল । আস্তে আস্তে সমস্তটাই কেমন আনুষ্ঠানিকতা। শ্বশুর- শাশুড়ির সেবা করে মিতুল, রান্নাবান্নায় যতটুকু সাহায্য করতে পারে, করে। তেমন একটা করেওনি বাপের বাড়িতে। ছোট দেওর উচ্চমাধ্যমিক দেবে, তাকে একটু-আধটু সাহায্য করে। তবু সারাদিন তেমন একটা কাজ নেই অঞ্জনের জন্য প্রতীক্ষা করা ছাড়া। অঞ্জনের প্রাইভেট ফার্ম , কাজের চাপ অত্যন্ত বেশি। ফেরে যখন একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে। এসেও বুড়ো বাপের সঙ্গেই সময় কাটায় বেশি, ভাইটাকে কিছু দেখিয়ে দেবার থাকলে দেয় , যে -মিতুলের জন্য সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকতো তাকে দেওয়ার মতো এনার্জি তখন কোথায়! ঘুমোয় যখন সারাদিন পরিশ্রমের পর, দু’ মিনিট পরেই নাক ডাকতে থাকে , গল্প করবে কি, তাকে তখন ধাক্কা মেরেও পাশ ফেরানো যায় না। হায় রে প্রেম ! মিতুল এখন বিনিদ্র চোখে ভাবে, এর চেয়ে ওই সপ্তাহে একদিনের প্রতীক্ষা তো অনেক ভাল ছিল। দু’ বছরের পর থেকেই জন্ম দিনের আগে রাত্তিরে জেগে থাকা, রাত বারোটার পরের দিনের প্রতীক্ষা, সব গেল ঘুঁচে । তারপর মুনিয়া এল কোলে । একটা অবলম্বন তবু মিতুলের । তাকে নিয়ে অঞ্জনের আদিখ্যেতাতেও একটা নতুন ধরনের আকর্ষণ। তবু তো আকর্ষণ, সেটাই বা কম কি। কিন্তু সেও তো পুরনো হয়ে আসে, ভাটা পড়ে যায় পুরনো প্রেমে ।
না, সম্পর্কটা ভেঙ্গে যায় নি। মিতুল এখনও চুল বাঁধে, রান্নায় সাহায্য করে , শশুরের সেবা করে,বোকা বোকা গল্প করে , অঞ্জন ৮ টায় ঘুম থেকে উঠে ৯ টার মধ্যে বেরিয়ে যায়, রাতে ফিরেই কোন কোন দিন ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ে । মিতুল এখন তার কাছে কোন দূরতর দ্বীপ। এটা তবু একটা মন্দের ভালো গল্প বললাম।
পরের টা দেখা যাক।
দৃষ্টান্ত দুই

ভবানীপুরের ছেযে সুমন ,কনট্রাক্টারী করে বাঁকুড়ায় । সিভিলের সিভিলের কাজ , বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজে কাজ পেয়েছিল একটা,তখনই আলাপ মধুমিতা সঙ্গে। সেকেন্ড ইয়ার ইংরেজি অনার্সের ছাত্রী। লাভ এট ফার্স্ট সাইট । এক বছরের মধ্যে একেবারে প্রেমের সমুদ্রে তুফান ।
এ ওকে না দেখে থাকতে পারে না, ও-ও একে না দেখে থাকতে পারে না। কলেজের কনস্ট্রাকশনের কাজ শেষ হয়, কিন্তু হৃদয়ের উচ্ছাসের তো কোনো শেষ নেই , ফলে অন্য কাজের মধ্যেও নিয়ম করে দেখা করতে হয় মধুমিতার সঙ্গে। আড্ডাবাজ ছেলে সুমন, বাঁকুড়ায় কাজ শেষ হলেই ফিরে আসবে ভবানীপুর, বন্ধু-বান্ধবদের পুরোনো আড্ডায় মজলিশ জমাবে , এটাই নিয়ম। কিন্তু নিয়ম মানতে গেলে বাঁকুড়া থেকে চলে আসতে হয়, আর চলে আসা মানেই মধুমিতার কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়া ।মধুমিতার অদর্শন তো তখন প্রায় অসহ্য,সুতরাং কাজ হাতে না থাকলেও বাঁকুড়ায় থাকাটা নিয়ম হয়ে গেল, ব্যবসার ক্ষতি করেও।
এরকম তো আর দীর্ঘদিন চলে না , দু ,আড়াই বছর পরে পাত্রীর বাবা-মার কাছে পাত্রের নিজেরই প্রস্তাব। মিয়া -বিবি রাজি, কাজেই কাজির কিছুই করার থাকেনা, সুমনের বাবার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যেতেই হয়। ব্যবস্থাদি সবই হয়ে যায়, বিয়েটাও হয়ে যায় নির । এতদিন যে ছিল দূরে দূরে, ক্ষণদর্শনের আড়ালে, এবার সে ঘরে এলো বিবাহিত স্ত্রী হয়ে । এল তো বটেই , কিন্তু তার পর? খুব বেশিদিন নয় মাত্র ছ -আট মাসের মধ্যেই সম্পর্কটা কেমন পুরোনো হয়ে এল, ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে এল। কাজের জন্য এখনও সপ্তাহের ৪-৫ দিন কাটিয়ে আসতে হয় বাঁকুড়ায় , মধুমিতা বিরহ ভোগ করে এই কটা দিন, অথচ ফিরে আসার পরও সুমনকে যে নিবিড় করে পাওয়া, সেটা আর পায় কই ! প্রথম কয়েকটা মাস বন্ধুবান্ধবদের আড্ডা বর্জন করেছিল, কিন্তু আড্ডাবাজ ছেলে সেটাও তা মেনে নিতে পারে না– ফলে যে মধুমিতার জন্য একদা প্রাণ উচাটন হতো, ঘরে বসে তার সঙ্গে দুটো কথা বলার ফুরসত তার আর হয় না।মধুমিতা বলে বাবা-মার সঙ্গে একবার দেখা করে আমার খবরটা অন্তত দিও । সুমন ভুলে যায়। একদিন বলে বাকুড়া তো আর যাওয়া হয় না, আমার কাজের ফিল্ড এখন দুর্গাপুর।মধুমিতা বলে , দুর্গাপুরেও কাউকে জুটিয়েছো নাকি? আমার সঙ্গে তো আর কথা বলতেও ইচ্ছে করে না দেখি ।
তুমিও জুটিয়ে নাওনা কাউকে এখানে । আমার বন্ধুদের সঙ্গে তো ঢলাঢলি তো কম করোনা দেখি ।
ছি ছি এরকম অসভ্য ইঙ্গিত তুমি করতে পারো ! আমি কি সেই ধরনের মেয়ে বলে তোমার মনে হয় নাকি? হ্যাঁ ,কী ধরণের মেয়ে সে তো জানাই আছে। ভালো রোজগারের ছেলে দেখে ঢলে পড়েছিলে, এখন আর একটু ভাল রোজগার-পাতি দেখে ভো -কাট্টা হয়ে যাও । প্রথম প্রথম কথা কাটাকাটি, তারপর প্রবল ঝগড়া । অভিভাবকদের দৌত্য ব্যর্থ । ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় বছর দেড়েকের মধ্যে,উদ্দাম প্রেমের অবসান ঘটে চরম পরিণতির মধ্যে দিয়ে ।
সাধারণ কারণ
স্বামীর মানসিকতার পরিবর্তন : রমনীয় প্রেম পর্বের পর তার ফলশ্রুতি হিসেবে পরিণয় এবং তারপর কি ফল লভিনু হায় তাই ভাবি মনের মত হতাশ দাম্পত্য জীবন যাপন করার প্রধান কারণটা একটু কাব্যিকভাবে বললে বলা যায়, অধিকাংশ পুরুষের মনোগত ধারণা ,Marriage is the sunset of love, অথচ সুখী দাম্পত্য জীবনের পক্ষে সত্য কথাটা হলো Marriage is the sunrise of love।
একটু বুঝিয়ে বলি কথাটা । কোনো মেয়ের সঙ্গে আলাপ হলো, চুটিয়ে প্রেম করলাম দু-তিন বছর, তারপর একটা শুভদিন দেখে বসে পড়লাম মাথায় টোপর পরে, ব্যাস , প্রেম পর্বের ইতি , আবার প্রেমিকা হয়ে গেল বউ ,আমার সেবা দাসী। প্রেমের সুবাস উড়ে গেল সাংসারিক কর্তব্যের হাজারো সমস্যায়– বউ তখন সংসারের যাবতীয় কাজের সহায়ক আর রাতে আর রাতে শয্যাসঙ্গিনী হয়ে অভ্যস্ত প্রমোদলিলার জোগানদাতার মাত্র । কথাটা আরো স্পষ্ট করে বললে এই রকম দাঁড়ায়, প্রেমপর্বে প্রেমের উন্মেষ ঘটতে পারে, কিন্তু প্রেম দিয়ে একটি নারীকে অধিকার করা, তার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা একটা বিরাট কাজ, তার ওপরই নির্ভর করে সুস্থ দাম্পত্য জীবন।
অন্য দিক থেকে বুঝিয়ে বলতে গেলে বলতে পারি বিয়ের পর একটি ছেলে ও মেয়ের জীবন খুব তাড়াতাড়ি একঘেয়ে হয়ে পড়ে কারণ সেটা একটা অভ্যস্থ জীবনে পরিণত হয় এবং সেখানে অনিশ্চয়তা বলে কিছুই থাকে না। প্রাক-বিবাহিত জীবনে একটি নারীর জন্য অনেক দিনের প্রতিক্ষা থাকে, তার পরেও নির্দিষ্ট দিনে দেখা হবে কিনা সে ব্যাপারে অনিশ্চয়তা থাকে। বিবাহিত জীবনে প্রতীক্ষার কোনো ব্যাপার নেই, আমার নিজস্ব একটি নারী আমার সেবার জন্য প্রস্তুত আছেই এবং সে আমাকে সঙ্গ দিতে বাধ্য — এই মনোভাব প্রেমকে নিষ্পেষিত করে একটা জৈবিক অভ্যাসে পরিণত করে মাত্র। প্রাক-বিবাহ পর্বে সারাদিনের প্রেমালাপটা বিবাহের পর ওই জৈবিক ক্রিয়া এসে দাঁড়ায় যেটাকে সমরেশ বসু তাঁর একটি উপন্যাসে বলেছেন ’10 মিনিটের ব্যাপার’। তার পরেও সেটা যে অস্বস্তিকর সেটা হলো এক প্রেমিকের সঙ্গে রাত্রিবেলায় মিলনটা হয়ে দাঁড়ায় একটা অভ্যাসের ব্যাপার। সৈয়দ মোস্তফা আলীর ‘শবনম ‘ উপন্যাসে একটি সুন্দর কথা আছে, নায়িকা বলেছে, তুমি আমার মিলনে অভ্যস্ত হয়ে যেও না, তুমি আমার বিরহে অভ্যস্ত হয়ে যেও না,।
যাঁরা মনে মনে ভাবছেন, বিয়ের আগে তো মন জুগিয়ে অনেক কথা বলেছি, একটু মন পাওয়ার জন্যহন্যে হয়ে ঘুরেছি , বিয়ে-করা বৌয়ের সঙ্গে আবার প্রেম করতে হবে, এ কি আদিখ্যেতা ! আমি বলব, আদিখ্যেতা নয়, দাম্পত্য সম্পর্ক তৈরি করার এটাই একমাত্র উপায়। ‘নষ্টনীড়’ গল্পের ভূপতির কথা একবার ভবুন, চারুর কথা তিনি ভাবতেন না, এমন নয় কিন্তু দেশের কথা এত ভাবতেন যে চারু বেচারাকে যে একটুও সময় দেওয়া হচ্ছে না, সে যে দিন দিন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে এটা তিনি নজরই করলেন না, আর প্রকৃতিতে শূন্যস্থান বলে তো কিছুই থাকতে পারে না, একদা কোন অমল বাতাস এসে তা পূর্ণ করে দেয়।
না, এই আশঙ্কার জন্য নয়, বউকে যেটুকু সময় দিতে পারেন সেটুকু সময়ই তাকে ভরিয়ে রাখুন। বিয়ের আগে চরম মিলনের সুযোগ অনেকেই পেতেন না বা পেতে চাইতেন না, কিন্তু সারাদিনের টুকিটাকি ছোঁয়াছুঁয়ি আর মাখামাখির রঙ্গে যে বেঁচে থাকতেন সেটাই কি খারাপ লাগতো ! বিয়ের পরেও সেই সোনালী দিনগুলো ফিরে আসবে না কেন? ওই একটি চরম জৈবিক ক্রিয়া ছাড়া কি আনন্দ পাবার কোনো উপায় নেই। পশুদের কাম চরিতার্থ করার একটি মাত্র উপায় আছে, মানুষের যৌনসুখ উপভোগের হাজারটা পথ খোলা আছে। আপনি তার নাড়ি -নক্ষত্র জানেন,তার গলায় কোথায় হাত দিলে সে আনন্দে অধীর হয়ে পড়ে ,তার কানের লতিতে ছোট্ট একটা দাঁতের চাপ কি শিহরণ আনে তার শরীরে,এ কথা আপনার চেয়ে বাসি আর কে জানে।কী হবে যদি ওই ‘দশ মিনিটের ব্যাপার’ রোজ নাই হয় ? জানবেন,কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গম কিন্তু অপরাধ ,তিনি আপনার স্ত্রি হলেও। একটু দেরি করে অফিস থেকে ফিরলেন , বউকে একবার নিষ্পেষিত করবার জন্য ছটফট করছেন , বউ ঘরেনেই , ছাদে বসে আছে– কোন কারণে মন খারাপ, আপনার লালসা চরিতার্থ না করে চুপটি করে পাশে গিয়ে বসুনতো ! হাতের ওপর আলতো করে হাতটা রাখুন তো ! এইভাবে যে প্রেমের যোগে এক হয়ে গেলেন তার চেয়ে বড়ো অধিকার আর কিছুই নেই — এবার বউয়ের একটা আগ্রাসী আলিঙ্গন আর চুম্বন বৃষ্টি আপনার কাছে নকত মধুর লাগে বলুন তো !
দাম্পত্য প্রেমের সম্পর্ক বলতে এটাই তো বলছি– আপনি স্ত্রীর কথা ভাবেন , আপনি তাকে বোঝেন ,তাঁকে আপনি বিশ্বাস করেন , তিনিও আস্থা রাখতে পারেন আপনার ওপর, এই বিশ্বাসের দুর্ভেদ্য দুর্গ তৈরি করা। বিয়ে করা মানেই সব ফুরিয়ে গেল না,বিয়ে করা মানে নতুন করে কিছু তৈরি হল।
স্ত্রীর মানসিক পরিবর্তন :পুরনো ধাঁচের সমাজ-ব্যবস্থায় বউ-কাঁটকি শাশুড়ির কথা অনেক শোনা যেত। এখনও শাশুড়ির দাপট একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়েছে বলা যাবে না, বিশেষ করে ছেড়ে যদি মায়ের কাজ কর্ম সম্বন্ধে অন্ধ হয়। তবে সংসারিই তো এখন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে, আর স্ত্রীদের অনেকেরই মনোভাব সেটা আরো ছোট করবার– একেবারে আপনি -কপনির সংসার, যেখানে শশুর-শাশুড়ি-ননদ-দেওর ইত্যাদির ঝামেলা থাকবে না।
আরো সোজাসুজি বলা যাক , প্রেমপর্ব যদ্দিন চলল ,ততদিন চলল ,মেয়ে তো ততদিন লজ্জাবতী লতা, কিন্তু সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে প্রেমিকা যখন স্ত্রী হয়ে উঠলেন তারপর থেকেই শুরু হয়ে গেলো তার একেশ্বরী হওয়ার দাপট– প্রেমিকা তখন আর কেবল স্ত্রী নন, পুরোদস্তুর ইস্ত্রী , তাঁর নিজের মনের মতন কেউ না হলে তাকে তিনি পালিশ করে মাটিতে মিশিয়ে দেবেন। আমার দাপট সহ্য করতে পারো,
থাকো নইলে মানে মানে কেটে পড়ো , এইটাই যে স্ত্রীর মনোভাব। এই পরিবর্তনটাও যে একশ্রেণীর স্ত্রীর মধ্যে দেখা যায় না, এরকম নয়, সে ক্ষেত্রে প্রেমের একেবারে চূড়ান্ত বিদায়, তখন থাকে কেবল অধিকারবোধ । আমার স্বামী অমুক অফিসে চাকরি করেন, আমার স্বামীর এইরকম প্রতিপত্তি, তিনি এত টাকা উপার্জন করেন– সুতরাং দিনান্তে তাঁর সঙ্গে একবার মধুর সম্ভাষণ হোক বা না হোক, তাঁর কি দরকার না দরকার ব্যাপারে নজর থাক আর নাই থাক, নিজের স্ট্যাটাস বাড়াবার ব্যাপারে নজর থাকে অত্যন্ত বেশি। ভালোবাসার এরকম করুণ পরিণতি খুব কমই দেখা যায়, ওই যে পুরোনো গান অছে না– ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রাণী’, অনেকটাই সেই জাতীয় ব্যাপার আর কি !
স্ত্রীর এই জাতীয় পরিবর্তনের দাম্পত্য সম্পর্ক তো টিকতে পরেই না, সংসাটাও তছনছ হয়ে যায়। খরচের অন্ত থাকে না অথচ সংসারের গোছ থাকে না কোন, কাজের লোকেরা লুটেপুটে খায় ,ছেলেমেয়েগুলো উচ্ছঙ্খল হয়ে যায় — বাবা -মার নিত্য র্অশান্তি দেখলে কোন সংসারের ছেলেই বা মানুষ হয় । আসল কথাটা আগেই বলেছি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং ভালোবাসা যদি না থাকে তাহলে দাম্পত্য সম্পর্ক টিকে থাকতে পারে না। কিছুই মেয়ের স্বভাবেই থাকে কোন রকমে বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করো — সেটুকু সময় প্রেম- টেম করে, কলেজে ফুর্তি -ফার্তা করে কাটিয়ে দাও, বিয়ের পরেই স্বমূর্তি ধারণ করো ।এতে স্বরাজ পাওয়া যেতে পারে,’স্টেটাস’ বাড়তে পারে , কিন্তু সম্পর্কটা বাঁচে না । বাঘিনীর রূপ ধরে স্বামীকে সে গ্রাস করতে পারে তবে ওই পুরোনো প্রবাদ তা ভুলে গেলে চলবে না–Nature abhors vacum, প্রকৃতি শূন্যতা পরিহার করে, স্বামী ও সংসারকে গ্রাস করার ফাঁকেই কখন অন্য কোনো বাঘিনী স্বামীকে গ্রাস করে নিয়েছে এইসব খাণ্ডারানি স্ত্রী জানতেও পারে না। সুতরাং যত খুশি স্টেটাস বাড়াও , কিন্তু স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্কটা সুস্থ রাখো ,এই একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে।

হীরেন চট্টোপাধ্যায়

[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *