[:bn]ভারততীর্থে ভগিনী নিবেদিতা[:]

[:bn]ভারততীর্থে ভগিনী নিবেদিতা[:]

March 7, 2018

[:bn](১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভগিনী নিবেদিতার প্রথম ভারতবর্ষে আগমন। তারপর স্বামী বিবেকানন্দের পদপ্রান্তে তার জন্মান্তর। ভারতবর্ষের সঠিক পরিচয় লাভের জন্য তিনি স্বামীজীর সঙ্গে ভারত তীর্থ পরিক্রমায় বের হন এবং ঐ বছরই তাঁর বালিকা বিদ্যালয় এর সূচনা হয়। গত ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভগিনী নিবেদিতার প্রথম ভারত আগমন, তাঁর জন্মান্তর, স্বামীজীর সঙ্গে ভারততীর্থ পরিচয় এবং তাঁর বালিকা বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করে এই প্রবন্ধটি প্রস্তুত করা হয়েছে। সেজন্য এর আলোচনার কালসিমা শুধুই ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ।)

১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি ‘মোম্বাসা’ জাহাজ কলকাতা বন্দরে থামল। লন্ডনের সদ্য ত্রিশ উত্তীর্ণ এক যুবতী– নাম মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল– কলকাতা বন্দরে নামলেন। লন্ডন থেকে কলকাতা কয়েক হাজার মাইলের ব্যবধান। ব্যবধান শুধু দূরত্বের নয়, ব্যবধান সাগর ও মহাসাগরের। ব্যবধান ধর্ম ও সংস্কৃতির,ব্যবধান সামাজিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের।কখনো কখনো সেই ব্যবধান প্রায় দুর্লঙ্ঘ্য। এই ব্যবধানের পটভূমি নিয়ে কলকাতায় নামলেন মার্গারেট –পরবর্তী কালের ভগিনী নিবেদিতা। জাহাজ থেকে নেমে মার্গারেট দেখলেন তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য জেটিতে দাঁড়িয়ে আছেন– স্বয়ং তাঁর গুরু স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর কল্পনার ,তাঁর ধ্যানের, ভারতবর্ষের মাটিতে প্রথম পা রাখার মুহূর্তে স্বামী বিবেকানন্দকে তাঁর দর্শন আমাদের মনে হয় তাঁর কাছে প্রতীকী হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে ভগিনী নিবেদিতার জীবনে ভারত এবং বিবেকানন্দ সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। গুরুর মধ্যে তিনি ভারতকে দেখতেন। ভারতের মধ্যে গুরুকে।

১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকা থেকে কলকাতায় আসেন মিসেস  সারা ওলি বুল এবং জোসেফিন ম্যাকলাউড। ফেব্রূয়ারি -মার্চেই দুটি জীর্ণ একতলা বাড়ি সহ বেলুড় মঠের জমি কেনা হয়ে যায়। মার্গারেট, ওলি, জোসেফিন প্রথমে কিছুদিন চৌরঙ্গীতে একটি হোটেলে ছিলেন। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দুটি বাড়ির মধ্যে বড়টিকে বাসোপযোগী করে স্বামীজীর অনুমতিক্রমে তাঁরা তিনজনে তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বাস করতে শুরু করেন। মঠ তখন নীলাম্বর মুখার্জির বাগানে ভাড়াবাড়িতে।  স্বামীজি সেখানে থেকে রোজ সকালে এসে আমগাছের নিচে তাঁদের সঙ্গে প্রাতরাশে যোগ দিতেন এবং তাঁর তিন পাশ্চাত্য শিষ্যাকে ভারতীয় সমাজ, পরিবার, সংস্কৃতি, ধর্ম, দর্শন, আধ্যাত্মচিন্তা এবং জীবনধারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। ভারতের মাটিতে গুরুর কাছে মারগারেটের সেই প্রথম ভারত পাঠের সূচনা। বস্তুত, বেলুড় মঠের বাড়িতে মঠ বাসীদের বাসের আগেই ব্রতধারিণী নিবেদিতার বাস করার দুর্লভ সৌভাগ্য হয়েছিল। ভারতের মাটিতে ভারতের সঙ্গে পরিচয়ের কি অসাধারণ সুযোগ ! আর সেই পরিচয় স্বয়ং বিবেকানন্দের পাদমূলে বসে ! আবার কী অপূর্ব সেই পরিবেশ ! বেলুড় মঠের পুণ্য প্রাঙ্গন, পাশেই ভারতের প্রতীক স্বরূপিনী গঙ্গা, একটু দূরেই গঙ্গার অপর তীরে একদিকে দৃশ্যমান যুগাবতার  শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনপীঠ দক্ষিণেশ্বর, আর  অন্যদিকে দৃশ্যমান না হলেও বাগবাজারে ১০/২ বোসপাড়া লেনে শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীর অবস্থান ! বেলুড়ে স্বামীজি ছাড়াও শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যান্য পার্যদবৃন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও আলাপচারিতার মাধ্যমে ভারতের জীবন্ত আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে মারগারেটের পরিচয় হচ্ছিল।

                                      ইতিপূর্বে ২২ ফেব্রুয়ারি শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি সাধারণ উৎসব দেখার সুযোগ ঘটল মারগারেটের। ওই সময় শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি এদেশের মানুষের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পরিচয় তিনি পেলেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি বেলুড় মঠের নতুন জমিতে স্বামীজি শ্রীরামকৃষ্ণের পূজা করলেন। বস্তুত, সেদিনই হল বেলুড় মঠের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা । এই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হওয়ার সৌভাগ্যও ঘটল মারগারেটের। ওইদিন মার্গারেট দক্ষিণেশ্বর দর্শনও করলেন। মন্দির,পঞ্চবটী দর্শন করে শ্রীরামকৃষ্ণের কক্ষে কিছুক্ষণ কাটালেন। এর কয়েকদিন পর এল মারগারেটের জীবনের সেই মহাদিন— তাঁর নিজের ভাষায়– “Day of days” । ১৭ মার্চ ১৮৯৮ বাগবাজারে বোসপাড়া লেনের ভাড়াবাড়িতে শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীকে দর্শন করলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন ওলি বুল ও ম্যাকলাউড। সারদাদেবীকে দেখে মারগারেটের মন অসীম আনন্দ ও শান্তিতে পূর্ণ হয়ে গেল। তিনি যেন মূর্তিমতী ভারত প্রতিমাকে দর্শন করলেন। ভারতের শান্তি, ভারতের প্রজ্ঞা, ভারতের শ্রী, ভারতের সৌন্দর্য, ভারতের পবিত্রতা, ভারতের আধ্যাত্মিকতা, ভারতের সত্তার সঙ্গে পরিচয় ঘটল মারগারেটের। শাশ্বত, সনাতন ভারতজননীর প্রতীক রূপে মার্গারেট তাঁকে দেখলেন। স্বামীজির কাছে মার্গারেট শুনেছেন ভারতের সহজ উদার বৈশিষ্ট্যের কথা। স্মরণাতীত কাল থেকে ভারত সকলকেই তার উদার বিস্তৃত বক্ষে স্থান দিয়েছে। বিদেশি বলে, বিধর্মী বলে, পর বলে সে কাউকে দূরে সরিয়ে দেয় নি। সকলকেই গ্রহণ করেছে, সকলকেই সে আপন করে নিয়েছে। মার্গারেট যখন সারদাদেবীকে দেখলেন, তখন বুঝলেন অনাড়ম্বর পরিবেশে, সাধারণ বেশভূষায় এই নারী সনাতন ভারতেরই প্রতীকস্বরূপিণী । মার্গারেট, সারা ও জোসেফাইনকে শ্রীশ্রীমা স্বতঃস্ফূর্তভাবে “আমার মেয়েরা” বলে সাদরে অভ্যর্থনা করলেন । একসঙ্গে আহারও করলেন। সস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরে, চুম্বন করে, মুহূর্তের মধ্যে তাঁদের তিনি আপন করে নিলেন। ধর্মের ব্যবধান, সংস্কৃতির ব্যবধান, ভাষার ব্যবধান সেই উদার গ্রহণের জাহ্নবীধারায় ভেসে গেল। ‘ম্লেচ্ছ’ বিদেশিনীদের সম্পর্কে সেকালের রক্ষনশীলতার দুর্গ বাগবাজার পল্লীতে জয়রামবাটীর সেই প্রায়-নিরক্ষরা বিধবা ব্রাহ্মণী যে বিপুল ঔদার্য ও হৃদয়ের (এবং অবশ্যই সাহসের) পরিচয় দিয়েছিলেন, তা চিন্তা করলে আমাদের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। মারগারেটের ভারত-পরিচয়ের ক্ষেত্রে এই ঘটনার তাৎপর্য ছিল সুদূরপ্রসারী।

                                        এরপর ২৫ মার্চ ১৮৯৮ এল মারগারেটের জীবনের সেই চিরস্মরণীয় দিন। তাঁর ভাষায় –“জীবনের সর্বাপেক্ষা আনন্দময় প্রভাত।” ওই প্রভাতে বেলুড়ে নীলাম্বর মুখার্জির বাড়িতে মঠের ঠাকুর ঘরে স্বামীজী মারগারেটকে ব্রহ্মচর্য-দীক্ষা দান করলেন। প্রথমে মারগারেটকে ভারতের আধ্যাত্ম দেবতা শিবের পূজা করালেন স্বামীজী। তারপরে হল তাঁর ব্রহ্মচর্য-দীক্ষা। তারপর ভারতের ইতিহাস-দেবতা বুদ্ধের অনুবর্তী হতে নির্দেশ দিয়ে বললেন : “যাও, যিনি বুদ্ধত্বলাভের আগে পাঁচশো বার অপরের জন্য জন্মগ্রহণ ও প্রাণবিসর্জন করেছিলেন, সেই বুদ্ধকে অনুসরণ কর।” দীক্ষাদান করে স্বামীজি মারগারেটের নতুন নামকরণ করলেন– নিবেদিতা।
মারগারেটের নবজন্ম হল। মার্গারেট হলেন নিবেদিতা। ভগিনী নিবেদিতা। গুরু শিষ্যাকে ঈশ্বরের কাছে ‘নিবেদন’ বা উৎসর্গ করলেন। নিবেদিতার জন্মের পূর্বে তাঁর জননী ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন, সন্তানকে তিনি ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করবেন। আজ তাঁর সেই প্রার্থনা পূর্ণ হল। তাঁর কন্যা আনুষ্ঠানিকভাবেই ঈশ্বরের চরণে নিবেদিতা হলেন।

                                                                             স্বামী বিবেকানন্দের কাছে ঈশ্বরের একটি প্রত্যক্ষ রূপ ছিল। সে রূপ হল তাঁর মাতৃভূমি ভারতবর্ষ এবং তার নারী ও জনগণ। সুতরাং সেদিন স্বামীজি নিবেদিতা কে উৎসর্গ করেছিলেন ভারতবর্ষ এবং তার নারী ও জনগণের কাজেও। একদিকে শিব অন্যদিকে বুদ্ধ এই ত্যাগীশ্রেষ্ঠ ছিলেন বিবেকানন্দের প্রিয় আদর্শ।একদিকে বেদ -উপনিষদ- পুরাণ, অন্যদিকে ইতিহাস। ভারতের চিরায়ত আধ্যাত্মসাধনার দুই প্রতীক–শিব ও বুদ্ধ। বিবেকানন্দের মধ্যে নিবেদিতা শিব ও বুদ্ধকে মূর্ত হতে দেখেছিলেন। স্বামীজীর কাছে নিবেদিতা শিখেছিলেন ত্যাগই ভারতের মর্মবাণী, ত্যাগই ভারতের মর্মধ্বনি। শিব ও বুদ্ধ এবং বিবেকানন্দ ছিলেন ত্যাগের সাধনায় স্বয়ংসিদ্ধ। ‘ত্যাগ’ মানে নিজের জন্য, নিজের বলে কিছু অবশিষ্ট না রাখা। ত্যাগ’ মানে আত্মনিবেদন। সেই মন্ত্রে, সেই সাধনায় ভারতের সেই চির প্রজ্বলিত হোমাগ্নিতে বিবেকানন্দ ব্রতধারীনী , ব্রহ্মচারিণী নিবেদিতাকে পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেছিলেন। বিবেকানন্দের মধ্যে নিবেদিতা মূর্ত হতে দেখে ছিলেন একাধারে তাঁর ঈশ্বরকে এবং তাঁর নতুন জন্মভূমি ভারতকে।

                                                                           ব্রহ্মচর্য দীক্ষার মাসাধিককাল আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ রবিবার বেলুড়ে দাঁ’দের ঠাকুরবাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ জন্ম-জয়ন্তীর সাধারণ উৎসবের দিন নিবেদিতা গোপালের মার সাক্ষাত লাভ করেছিলেন। অল্পদিনের মধ্যে অন্তত আরও একবার তিনি গোপালের মাকে দর্শন করেছিলেন দক্ষিণেশ্বরের কাছে তাঁর কামারহাটির বাড়িতে। এই দর্শন সম্পর্কে স্বামীজী আবেগময় কণ্ঠে বলেছিলেন : “আহা, তোমরা প্রাচীন ভারতকে দেখে এসেছ। ঈশ্বরের জন্য প্রার্থনা ও অশ্রুবর্ষণের ভারত ! অতন্দ্র জাগরণ ও উপবাসের ভারত !…..” অর্থাৎ গোপালের মার মধ্যে নিবেদিতা দেখলেন প্রাচীন ভারতকে— যে ভারত ঈশ্বর ভিন্ন আর কোন কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না এবং ঈশ্বরের জন্য সর্বস্ব সমর্পণ করতে ব্যগ্র -ব্যাকুল। অন্যদিকে শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীর মধ্যে নিবেদিতা দর্শন পেয়েছিলেন একইসঙ্গে প্রাচীন, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ভারতের অর্থাৎ সনাতন, শাশ্বত ভারতের। নিবেদিতার সেই উপলব্ধিকে পুষ্ঠ করেছিল বেলুড়ে গঙ্গাতীরে শ্রীরামকৃষ্ণের পার্ষদবৃন্দের প্রেরণাপ্রদ  সান্নিধ্য। সর্বোপরি ছিলেন ভারতের অপর বিগ্রহ, তাঁর গুরু– স্বামী বিবেকানন্দ। অবশ্য শ্রীশ্রীমার মধ্যে নিবেদিতা দেখেছিলেন ভারতীয় নারীর আদর্শ প্রতিমাকেও।

                                                         সে সময়ের কথা নিবেদিতা স্বয়ং তাঁর ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছেন : “স্বয়ং স্বামীজি সেখানে (বেলুড়ে) আসতেন।…. বেশির ভাগ, তিনি আজ একটি, কাল একটি–এরকম করে ভারতীয় ধর্মগুলিই  আমাদের কাছে বর্ণনা করতেন ; তাঁর যখন যেমন খেয়াল হত, যেন সেই অনুসারেই কোন একটিকে বেছে নিতেন। কিন্তু তিনি কেবল যে ধর্ম বিষয়ক উপদেশই  আমাদের দিতেন, তা নয়। কখনো ইতিহাস, কখনো লৌকিক উপকথা, কখনো বা বিভিন্ন সমাজ, জাতিবিভাগ ও লোকাচারের বহুবিধ উদ্ভট পরিণতি ও অসঙ্গতি– এসকলেরও আলোচনা হত। বাস্তবিক,  তাঁর শ্রোতৃ বন্দের মনে হত যেন ভারতমাতা শেষ এবং শ্রেষ্ঠ পুরাণস্বরূপ হয়ে তাঁর শ্রীমুখাবলম্বনে স্বয়ং প্রকটিত হচ্ছেন।

                                                        বেলুড়ে গঙ্গাতীরে ও গঙ্গাবক্ষে স্বামীজীর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে ও শিক্ষায় তার গুরুভাইদের স্নেহময় তত্ত্বাবধানে গোপালের মা এবং শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীর প্রেরণাদায়ী প্রভাবে নিবেদিতা চিরন্তনী ভারত সত্তার পরিচয় পেলেন। এইভাবে ভারতবর্ষের ভূমা সত্তার সঙ্গে নিবেদিতার পরিচয় হল। এবার প্রয়োজন ভূমি-সত্তার সঙ্গে– মাটি ও মানুষের সঙ্গে পরিচয়। গুরু এবার নিবেদিতাদের সঙ্গে নিয়ে চললেন ভারত দর্শনে।

                                                                         ১১ মে ১৮৯৮ বিকালে ট্রেন পথে হাওড়া স্টেশন থেকে স্বামীজীর নেতৃত্বে দলটির যাত্রা শুরু হল। প্রথম গন্তব্য আলমোড়া। ট্রেনেই স্বচক্ষে ভারত দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে নিবেদিতার ভারত-আবিষ্কার শুরু হল। পরদিন ভোরে ট্রেন পাটনা পৌঁছলে সেখানে থেকেই ভারত সম্পর্কে স্বামীজীর শিক্ষাদান শুরু হল। প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা লিখেছেন : “স্বামীজি বহু সময়ে তাঁহার পাশ্চাত্য শিষ্যগণের কামরায় অবস্থান কালে দৃষ্টিপথে যাহাই অসিত তাহারই ব্যাখ্যা করিতেন। কাশীর ঘাটগুলির প্রশংসা করিলেন, লাখনৌ -এর প্রসিদ্ধ শিল্পদ্রব্য ও বিলাস- উপকরণ গুলির নাম ও গুণ বর্ণনা করিলেন। বিশ্রুত মহানগরী গুলির বিখ্যাত কীর্তিসমূহ ব্যাখ্যা করতে যেমন তাঁহার কোন ক্লান্তি ছিল না, তেমনি আবার সাধারণ দরিদ্র কৃষকের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা-বর্ণনায় তাঁহার অসীম উৎসাহ ছিল।”

                                           অবশেষে তাঁরা ১৩ মে ভোরে কাঠগোদামে “হিমালয়ের সম্মুখে” উপস্থিত হলেন। ট্রেন যাত্রা শেষ হল, কিন্তু ক্ষেত্র শিক্ষা (field education) গভীরতর মাত্রা লাভ করল। হিমালয়ের সমুন্নত প্রকাশ করল নিবেদিতাকে মুগ্ধ করল। কলকাতা, বেলুড় , পাটনা, কাশিতে গঙ্গাকে তিনি দেখেছেন। ভারতের প্রাণপ্রবাহিণী গঙ্গা ! এবার স্বামীজি দেখালেন হিমালয়কে। হিমালয় যেন ভারতের সহস্রার। সেখানে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে ভারতের সহস্র সহস্র বছরের শত-সহস্র সাধকের সাধনা। স্বামীজি বললেন : ভারতে তুমি দারিদ্র দেখেছ, অজ্ঞতা দেখেছ, কুসংস্কার দেখেছ, আবর্জনা দেখেছ। এবার দেখো গগনচুম্বী অসীম অনন্ত হিমালয়কে। ভারতেরই শুধু হিমালয় আছে। হিমালয়ই যেন ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষ যেন হিমালয়ের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে ঊর্ধ্বশীর হয়ে  ভোগবাদ ও ইহসর্বস্বতাকে উত্তরণ করার উদার আহ্বান জানিয়ে আসছে।

                                 ক্রমে কাঠগোদাম থেকে নৈনিতাল এবং সেখান থেকে আলমোড়ায় এসে সকলে একমাস অবস্থান করলেন। একদিন ঊষার আলোক-উদ্ভাসিত তুষারশৃঙ্গের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে স্বামীজি নিবেদিতাকে বললেন : “ঐ যে ঊর্ধ্বে শ্বেতশুভ্র তুষার মন্ডিত  শৃঙ্গরাজি , উনিই শিব ; আর তাঁর ওপর যে আলোকসম্পাত হয়েছে, উনিই  জগজননী !”  একদিন ‘তরাই ভূখণ্ড’ অতিক্রম করার সময় স্বামীজি নিবেদিতাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন : “এখানেই বুদ্ধের জন্মভূমি !” অধ্যাত্ম-বিষয় থেকে সাহিত্য, ইতিহাস, শিল্প, স্থাপত্য প্রভৃতি কোনো বিষয়ই তাঁর আলোচনা থেকে বাদ যেত না এবং বলা বাহুল্য, সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভারত এবং শুধুই  ভারত।

                             অতঃপর ভূস্বর্গ কাশ্মীর এবং তুষারতীর্থ অমরনাথ। যাত্রীদলের মধ্যে অমরনাথের যাত্রী শুধুই গুরু এবং শিষ্যা। যাত্রাপথে নিবেদিতার নিবিড় পরিচয় ঘটল ভারতের নানা সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীকুলের সঙ্গে, যাঁরা ভারতের চিরায়ত অধ্যাত্মসাধনাকে সজীব রেখেছেন। অমরনাথে তুষারলিঙ্গের সঙ্গে শিবময় স্বামিজিকে দেখার দুর্লভ সৌভাগ্য হল নিবেদিতার।

                                             একসময় শেষ হল সেই অসামান্য ভ্রমণ। এই ভ্রমণের মাধ্যমে নিবেদিতা চিনলেন ভারতবর্ষকে। তার মাটি ও মানুষকে, তার ঐতিহ্য ও আদর্শকে। বুঝলেন ভারত প্রাচীন, কিন্তু নবীন সম্ভাবনায় পূর্ণ। ভারত মৃত্যুহীন। ভারতের কাজে নামার আগে তার এই উপলব্ধি ছিল অত্যাবশ্যক। সেই উপলব্ধি কত গভীর ছিল তার পরিচয় তিনি দিয়েছেন তাঁর ‘মাস্টার এস আই স হিম’,’দ্য ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ’,ক্রেডল টেলস অফ হিন্দুইজম’,ফুট ফলস অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি ‘ ইত্যাদি গ্রন্থে।

                                                                            তবে এই ভ্রমণ সবসময় নিবেদিতার পক্ষে বাহ্যিকভাবে প্রীতিকর হয়েছিল তা নয়। কারণ, মাঝে মাঝেই স্বামীজীর আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত কঠোর ও রূঢ় তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকে। কখনো কখনো নিবেদিতার মনে হয়েছে স্বামীজী যেন তাঁর সম্পর্কে অত্যন্ত উদাসীন এবং বিরক্তও। আসলে স্বামীজি অন্তর থেকে চাইছিলেন, ভারতের কাজের জন্য উদগ্রীব নিবেদিতাকে ভারতেকে আপন স্বদেশ বা ততোধিক জ্ঞানে গ্রহণ করতে হবে। তাঁর জন্মগত সংস্কার, তাঁর স্বজাতিপ্রীয়তা ও সংস্কৃতিকে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে, এমনকি তাঁর ইংল্যান্ড-জীবনের সমস্ত স্মৃতিকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলতে হবে। ভ্রমণকালে তা দ্ব্যর্থহীন  ভাষায় স্বামীজী শিষ্যাকে বলেছিলেন। বস্তুত, অন্য যে কারো পক্ষে ওই শর্ত পূরণ করা ছিল অসম্ভব। নিবেদিতার মতো প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্না এবং দৃঢ় সংকল্পের অধিকারিণীর পক্ষে তা অধিকতর কঠিন ছিল।

                                                             কিন্তু অবশেষে সেই কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেন নিবেদিতা। স্বামীজীর প্রতিটি কথা ও আচরণে তিনি দু’হাত ভরে শুধু শিক্ষনীয় সম্পদই আহরণ করেছিলেন এবং ভারতের জন্য নিঃশেষে নিবেদন করতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করেছিলেন। পিতা এবং গুরু তাঁর কন্যা এবং শিষ্যাকে এই পর্বে নিজের মনের মতো করে নির্মাণ করেছিলেন। কন্যা এবং শিষ্যাও নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। এখন তিনি প্রস্তুত ভারতের কাজে নামার জন্য—গুরুর পরিকল্পিত ভারতীয় নারীর শিক্ষাদানের ব্রতে, যা শ্রীশ্রী মায়ের আশীর্বাদধন্য হয়ে রূপলাভ করেছিল এই ভ্রমণের অব্যবহিত পরেই — ১৩ নভেম্বর ১৮৯৮। নিবেদিতা তাঁর বন্ধুকে চিঠিতে লিখলেন : “অনেক কিছুই শিখেছি।…. নিজেকে এত সুখী মনে হচ্ছে যে, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

                                   এই ভ্রমণকালে অপরিসীম শান্তি ও আনন্দ, আবার অবর্ণনীয় মানসিক সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্বের মাধ্যমে যে নিবেদিতা বের হয়ে এলেন তিনি আর কোনোভাবেই আগের ব্যক্তিটি নন। এখন তাঁর সত্যি সত্যিই নবজন্ম লাভ হয়েছে। জ্যোতিস্মতি নিবেদিতা অগ্নিশুদ্ধা হয়ে উঠেছেন। তাঁর অন্তর থেকে অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে তাঁর স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি সমস্ত অনুরাগ। এখন থেকে ভারতই হয়ে উঠলো তাঁর নতুন জন্মভূমি, ভারতবাসী হয়ে উঠলো তাঁর স্বজাতি, ভারতের দুঃখ তাঁর দুঃখ, ভারতের কল্যাণ তাঁর কল্যান। তাঁর নিজের লেখায় বাঙময় হয়ে উঠলো তাঁর অন্তর্লীন সেই গভীর অনুভূতি : “এবছর দিনগুলি কি সুন্দরভাবেই না কেটেছে ! এই সময়ই যে আদর্শ বাস্তবে পরিণত হয়েছে ! প্রথমে নদীতীরে বেলুড়ের কুটিরে, তারপর হিমালয়-বক্ষে নৈনিতাল ও আলমোড়ায় ,পরিশেষে কাশ্মীরে নানাস্থানে পরিভ্রমণকালে –সর্বত্রই এমন সব সময় এসেছিল, যা কখনো ভোলার নয়, এমন সব কথা শুনেছি যা আমাদের সারা জীবন ধরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে।”

                                                         অবিস্মরণীয় সেই অভিজ্ঞতার দীপ্তি নিবেদিতার সমগ্র ভবিষ্যৎ জীবনপথকে চিরতরে আলোকিত করেছিল। তাঁকে ভারততীর্থে প্রকৃত পূজারিণীতে রুপান্তরিত করেছিল, যিনি আমৃত্যু জপ করতেন “ভারতবর্ষ, ভারতবর্ষ, ভারতবর্ষ ! মা, মা, মা !”

স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ

[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *