[:bn]ভুলে যেতে চাই[:]
[:bn]ভুলে যেতে চাই[:]
April 5, 2018[:bn]
বিষয়বস্তু : সন্তানহারা পিতামাতার ব্যাথা
একটি মৃত্যুর ঘটনা চেয়ে যে কারো জীবন শূন্য করে দিয়ে যেতে পারে তা আমার মেজমাসি প্রতিদিন প্রমাণ করছেন। তাঁর একমাত্র সন্তান প্রিয়তোষের মৃত্যুর পর শোকে -দুঃখে এমন অবস্থা হয়েছিল যে ওঁকে বাঁচানোই দায় হয়েছিল আমাদের। বিলাপের সুরে ক্ষণে ক্ষণে বুক চাপড়ে বলে উঠতেন, আমার পিকুকে ছেড়ে আমি কি করে বাঁচব বল ! আমার আর বাঁচার দরকার নেই, আমার সব শেষ হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন ওঁরা। শুধু মেজমাসি নয়, রতন মেসোও। উনি পুরুষ মানুষ হলেও, পিতা তো। পুত্র হারানোর বেদনা যে তাঁকেও কতটা শোকাহত করেছিল তা তাঁর জীবনাচরণ বদলে যাওয়ার ঘটনাতেই প্রমাণিত।
আমরা যারা আত্মীয়-স্বজন আছি তারাও এই দুই আত্মজনকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। পিকুর অকাল প্রয়াণ আমাদের জীবনেও প্রভাব ফেলেছে। মেজমাসি ,মেসোমশাই আমাদেরকে খুব ভালবাসতেন। তাঁদের এমন অস্বাভাবিক দুর্দশার জীবন আমরা মেনে নিতে পারি না। কিন্তু কি করব ভবিতব্য তো মেনে নিতেই হবে !
পিকু মাত্র বারো বছর বয়সে যে দুর্ঘটনায় মারা গেছে সেই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। বারো বছরের চঞ্চল দুষ্টু ছেলেটা খেলতে গিয়ে নিজের দোষে মারা গেছে। সে বাড়ির পাশে একটা বাগানে আম পাড়তে ঢুকে ছিল। তারপর উঁচু পাঁচিল টপকে পালাতে গিয়ে পাথরের ওপর আছড়ে পড়ে। কেউ কিছু বোঝার আগেই তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গিয়েছিল।
সেই অর্থে পিকুর মৃত্যুর জন্য অন্য কেউ দায়ী নয়। বাগানের মালিরা সজ্ঞানে তাকে তাড়া করেনি, ভয় দেখায়নি। কিশোর বয়সের স্বাভাবিক ধর্মের ছটফটানিতে তার এই মর্মান্তিক পরিণতি। সেদিন সারা পাড়ায় কোন বাড়িতে হাঁড়ি চড়েনি। এতটাই শোকগ্রস্ত হয়েছিল পাড়া-প্রতিবেশী।
তারপর কেটে গেছে প্রায় ছ-সাত মাস।এই ছ’মাসেও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি মেজমাসি আর রতনমেসো। বাড়ির কোন কাজ করতে ভাল লাগেনা মাসির। যেটুকু না করলে নয়, সেটুকু সেরে প্রায় সারাদিন মনমরা হয়ে বসে থাকেন। আর যখন তখন পিকুর ছোটবেলাকার ছবিগুলো দেখেন আর কাঁদেন। অন্নপ্রাশনের সময় কি সুন্দর গোলগাল চেহারা ছিল পিকুর। স্কুলের স্পোর্টসে একবার দৌড়ে সেকেন্ড হয়েছিল, পুরস্কার হাতে সে ছবি এলবামে দেখে মাসি কেন, আমরাও ডুকরে কাঁদি । আর আমাদের ভাইবোনদের মোবাইল ক্যামেরায়, এমনকি গত বছরের মামাবাড়ির দুর্গা পুজোর ছবি গুলো যেন জ্যান্ত বিষাদ ! দেখা যায় না, হু হু করে কান্না আসে। তবুও তো আমি তার মাস্তুতো দিদি। মা-বাবার দুঃখ কতটা গভীর ক্রমশ বুঝছি।
কিন্তু এভাবে তো মাসি-মেসোও বাঁচবে না। ওরা তো অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আমরা ভাইবোনেরা সবাই মিলে একটা পরিকল্পনা করলাম। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী যেখানে যত শিশু-কিশোরের মৃত্যু ঘটেছে তা সবিস্তারে মাসি আর মেসোকে জানানো হবে। শোক দিয়ে শোক কাটানো অথবা বিষে বিষক্ষয়ের তত্ত্ব নয়।এ স্বয়ং গৌতম বুদ্ধের সেই অমোঘ পরোক্ষ শিক্ষা, পুত্রহারা বেদনার্ত মাতা যখন কাঁদতে কাঁদতে গৌতম বুদ্ধের কাছে গিয়ে মৃত পুত্রের প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন, তখন তিনি তাঁকে বলেছিলেন, নগরে যে বাড়িতে কোন মৃত্যু ঘটেনি সেখান থেকে একমুঠো সরষে আনতে।
টিভির নিউজ চ্যানেল খুলে, খবরের কাগজের পাতা মেলে ধরে, দুর্ঘটনায় অপঘাতে অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েদের মৃত্যুর সংবাদ গুলো আমরা এই দম্পতিকে দেখাই। তারপর খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করি এইসব ছেলেমেয়েদের মা-বাবার অবস্থাগুলো। অনেক মা-বাবা কি কঠিন বাস্তবকে সহজভাবে মেনে নিয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন। কেউবা সামলে উঠেছেন এই তীব্র শোক। ফিরে যাচ্ছেন জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে।
এক সময় ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন মেজমাসি।আমি তাঁকে কিছু দুঃখের রবীন্দ্র সংগীত শোনালাম। বিষাদের সুরে ভরা সেই গানের বাণীর ব্যঞ্জনায় মাসির অভিব্যক্তি বদলে গেল। একসময় মাসিও সুর মেলাতে থাকেন। রবীন্দ্রসংগীত যেন মাসির অবলম্বন হয়ে ওঠে।
এভাবেই একদিন মাসি আর মেসোমশাই কে আমরা বোঝাতে সক্ষম হই। ‘স্মৃতি সতত সুখের’ ছেলের অ্যালবামের ছবিগুলো দেখতে দেখতে তাঁরা যেন সেই সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন হতে থাকলেন। আমরা একটু স্বস্তি পেলাম।
আশ্বিনের মাঝামাঝি। পুজোর আবহ। চতুর্থী-পঞ্চমী– এভাবে পুজো এগিয়ে আসছে। হঠাৎ সপ্তমীর দিন মাসি আমাকে বললেন নিরু, কাল আমি ঠাকুর দেখতে যাব।
বেশ ভালো তো। আমরা তোমাকে নিয়ে যাব—
ভেবে দেখলাম, মন্ডপে গেলে আমি আমার পিকুর মতো অনেক পিকুকে দেখতে পাবো। তাদের কাউকে ডেকে আদর করব, কাউকে ডেকে কিছু খাওয়াবো, কাউকে নতুন জামা কিনে দেবো। এ হবে না ? প্রশ্ন করলেন মাসি।
আমি বললাম, খুব ভালো হবে।
মেজমাসি বললেন, পিকুর বন্ধুদেরকে খবর দে। আমি তাদের পুজোর জামা প্যান্ট কিনে দেবো। আমার এক প্রিয়তোষ চলে গেছে, আরও আরো হাজার প্রিয়তোষ রয়েছে আমার আশেপাশে।
আমি সুযোগ পেয়ে বললাম, বিশেষ করে অনেক শিশুর বাবা-মাও তো মারা গেছে। সেসব অসহায় শিশুদের মা-বাবার ভূমিকা পালন করতে পারো তোমরা। তারাও বেঁচে যাবে আর তোমরাও পুত্রশোক ভুলে থাকবে।
তা যা বলেছিস।
পরদিন অষ্টমীর সকাল। প্রিয়তোষ ওরফে পিকুর কয়েকজন প্রিয়তম বন্ধুকে ডেকে এনে হাজির করলাম মেজমাসির বাড়িতে। মাসি সবাইকে নিয়ে বাজারে যাবেন। ওদের পছন্দমত জামা প্যান্ট কিনে দেবেন। এঘটনায় আনন্দে ভরে গেল মাসিদের বাড়ির পরিবেশ। তারপর দুটো-তিনটে টোটো ডেকে যখন আমরা বাজারের দিকে রওনা হলাম, আমার মনে হল এ বাড়ির বিষাদ যেন ঐ টোটো তে চড়ে বিদায় হয়ে যাচ্ছে। পরে বাজারে সবার পছন্দের জামা-জুতো কেনা হয়ে গেলে, মেজমাসি তাদেরকে দোকানে নিয়ে গিয়ে মিষ্টি খাওয়ালেন। পিকুর বন্ধু ঋক, দেবার্ঘ্য, সৌমাল্য, বৃত, দময়ন্তীদের তৃপ্তির আলো মাসি আর মেসোর মুখে-চোখে প্রতিফলিত হতে দেখে আমার মনটাও ভরে উঠল। তারপর ছেলেগুলো যখন মাসি- মেসোকে প্রণাম করে যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিল, মাসি আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সে প্রবল কান্নার ধমক আমাকে বুঝিয়ে দিল, সন্তানহারা পিতা-মাতার ব্যথা স্তিমিত হতে থাকলেও নিঃশেষ হয়ে যায় না কোনদিনই। আমৃত্যু বহমান থাকে সেই সন্তানশোক।
তপোময় ঘোষ
[সোহিনী সরকার স্মৃতি -সাহিত্য প্রতিযোগিতার ৩য় পুরস্কৃত গল্প ]
[:]