[:bn]মহিষাদল রাজবাড়ির রথযাএা[:]

[:bn]মহিষাদল রাজবাড়ির রথযাএা[:]

July 5, 2018

[:bn]ড. দেবব্রত দাস

”রথযাত্রা লোকারণ্য মহাধুমধাম

ভক্তরা লুটায়ে পথে করিছে প্রনাম।”

আষাঢ় মাসের রথযাত্রার কথা বলছি। রথযাত্রার কথা বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রার চিত্র।পুরীর রথযাত্রা ছাড়াও বারিপদার রথযাত্রাও বিখ্যাত।   আর আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে বিখ্যাত মাহেশের রথযাত্রা। মাহেশের পরেই মহিষাদলের  রথের খ্যাতি। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলের ঐতিহ্যমন্ডিত কাঠের রথের কথা  সুবিদিত। মহিষাদলের রাজ-পরিবারের দুর্গোৎসব ও রথযাত্রা- দুয়েরই একসময় খ্যাতি ছিল  ভারতজোড়া। দুর্গাপূজা আজও হয়। এখনও মেলা বসে, এখনও প্রতিপদাদি কল্পেই পূজারম্ভ হয়, রাজবাড়ির তোপধবনি শুনেই এখনও  তমলুকের বর্গভীমা  দেবীর সন্ধিপূজা  শুরু হয়। কিন্তু আজকের দুর্গোৎসব অতীতের ছায়ামাত্র। তবে মহিষাদল রাজবাড়ি  রথযাত্রা আজও আগের মতোই জমজমাত-জাকালো। একমাসব্যাপী রথের মেলা আজও একইরকম প্রাণবন্ত।

  কলকাতা থেকে ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে গেলে, ডায়মন্ডহারবারের কয়েক  কিলোমিটার আগে সরিষা। সরিষা থেকে যেতে হবে নূরপুর, যা বর্তমানে রায়চক নামে  খ্যাত। এই রায়চক বা নূরপুর থেকে গঙ্গা পার হয়ে গেঁওখালি। গেঁওখালি থেকে মহিষাদল।  অথবা হাওড়া স্টেশন থেকে দক্ষিণ- পূর্ব রেল পথে মেচেদা স্টেশন। মেচেদা থেকে হলদিয়াগামী বাসে চড়তে হবে, ভায়া তমলুক। পথে পড়বে মহিষাদল বাজার।  মহিষাদল বাজারে নেমে ডানদিকে গেলে মহিষাদল রাজবাড়ি। আবার কলকাতা থেকে সরাসরি বাসেও মহিষাদল যাওয়া যেতে পারে।

 মহিষাদলের রাজাদের একসময় অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার সবচেয়ে বড় জমিদারি ছিল।  বীরনারায়ণ রায়চৌধুরী এই জমিদারির পত্তন করেন। তার অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ কল্যাণ রায়চৌধুরী। জমিদারির খাজনা আদায় করতে না পেরে কল্যাণ রায়চৌধুরী জনার্দন  উপাধ্যায়ের সাহায্য চান। জাতিতে সামবেদীয় কনৌজিয়া ব্রাহ্মণ জনার্দন উপাধ্যায়  আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীতে ব্যবসার জন্য উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ থেকে এখানে এসেছিলেন।

কালক্রমে জনার্দন উপাধ্যায় এখানকার জমিদার হন। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে এই বংশের আনন্দলাল উপাধ্যায় মারা যাওয়ার পরে তাঁর ধর্মপরায়ণা সহধর্মিনী রানি জানকী রাজত্বভার  গ্রহণ করেন। আনন্দলাল অপুত্রক ছিলেন, যদি ও তিনি কুটুম্ব- পুত্র মতিলাল পাঁড়েকে  পোষ্য গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি নাবালক  থাকায় রানি জানকী রাজ্য চালাতেন। নয় বৎসর পরে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে রজনকীর আমলেই মহিষাদল রাজবাড়িতে প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন হয়। মহিষাদলের রানি  জানকী গুমগড় পরগনা প্রতিষ্ঠা করেন। রানি জানকীর পোষ্যপুত্র ছিলেন দেবপ্রসাদ গর্গের পিতামহ। জনশ্রুতি আছে যে, মহিষাদল রাজপ্রাসাদের বারবাড়িতে যে সাধুনিবাস ছিল, সেখানে ঠাঁই নিয়েছিলেন এক সাধু। সেই সাধুর সঙ্গে ছিল সুদর্শন ও সুলক্ষণযুক্ত উত্তর প্রদেশীয় একটি বালক। রানি জানকীর চোখে পড়ে বালকটি। তার ভাগ্য খুলে যায়। রানির আশ্রয়ে সে মানুষ হয়। সেই হল দেবপ্রসাদ গর্গের পিতামহ। ক্রমে ক্রমে রাজা হন লছমন প্রসাদ গর্গ, জ্যোতিপ্রসাদ গর্গ ( রাজত্বকাল ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ), সতীপ্রসাদ গর্গ,দেবপ্রসাদগর্গ।

রানি জানকী দেবী ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মহিষাদল রাজপরিবারের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন। দেবদ্বিজে অচলা ভক্তি থাকায় তিনি তাঁর রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মোট ১০৮ টি  মন্দির স্থাপন করেন। এগুলির মধ্যে অন্যতম পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদিয়া মহকুমার নন্দীগ্রামে জানকী নাথ মন্দির, যেখানে অধিষ্ঠিত বংশীধারী শ্রীরামচন্দ্রের বিগ্রহ। “১২১০ সালে (১৮০৩ খ্রি:) ধর্মপ্রাণা রানি গুমগড় পরগনার নন্দীগ্রাম নামক স্থানে জানকীনাথের মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়া সেবার্থ বহু পরিমিত ভূমি প্রদান করেন।” (মহিষাদল রাড়াজকাহীণ , ভগবতীচরণ প্রধান পৃঃ- 29)

রানি জানকী দেবীর বিশেষ আগ্রহে এবং উৎসাহে মহিষাদলে রথযাত্রা শুরু হয় ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে। এর আগে, ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে রানি জানকী দেবী মহিষাদল রাজবাড়ির ঠিক সামনেই প্রায় ১০০ ফুট  মন্দির তৈরি করে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন রাজপরিবারের  কুলদেবতা মদনগোপাল জীউকে। জনশ্রুতি রয়েছে যে, একদিন একদল প্রজা এসে রানি জানকীর কাছে আবেদন জানান,  শ্রীক্ষেত্র পুরীর মত  মহিষাদলেও রথযাত্রা চালু করুন। রানিমাও প্রজাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে মহিষাদলে  রথযাত্রার প্রচলন করেন, যা আজও সগৌরবে অনুষ্ঠিত হয়, এবং রানিমার জয়   ঘোষণা করে।

রথযাত্রার সময়, মহিষাদলগামী সব রাস্তাই লোকে লোকারণ্য। সবাই চলেছেন মহিষাদলের রথের মেলায়। শাস্ত্রে বলা হয়েছেঃ”রথে চ বামনং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।” -অর্থাৎ রথস্থিত শ্রীভগবানকে দর্শন করা মহাপুণ্যের ব্যাপার, যে করে তার আর পুনর্জন্ম হয় না। তাই রথযাত্রায় মুক্তিপিপাসু মানুষ দলে দলে যোগ দেয়, হুড়োহুড়ি করে রথের দড়ি টানার জন্য। এর সঙ্গে আছে রথের  মেলা দেখার টান, আনন্দ- উপভোগের আশা।

মহিষাদলের রথের মেলা বাংলার সমাজ জীবনের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। টানা এক মাস ধরে চলে এই মেলা। আজও সেখানে গ্রাম্য ভাবেরই প্রাধান্য। পাঁপড়ভাজা আর গরম জিলিপির গন্ধে ম-ম করে চারিদিক। কী না পাওয়া যায় সেখানে। অ্যালুমিনিয়ামের, স্টেনলেস স্টিলের বাসনপত্র, প্লাস্টিক আর নাইলনের  নানান জিনিস। এর সঙ্গেই রয়েছে সাবেকি ঢঙের দা- কাটারি,বটি, কাস্তে, কদাল,খন্তা কুড়ুল,বর্শা এবং নানান গাছ-গাছালির চারা। এর সঙ্গে আছে আবার পাখি বেচাকেনা। সব মিলিয়ে মহিষাদলের রথের মেলা একেবারে জমজমাট।

রথযাত্রা শুধু ধর্মীয় উৎসবই নয়, এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে সামাজিক বন্ধনের শিক্ষা। হাজার হাজার মানুষ রথ টানে- তা না হলে রথ চলবে না।অর্থাৎ সমবেত শক্তিতে অচল রথ সচল হয় এই সত্যটা রথযাত্রার মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সহস্র মানুষের সমবেত প্রয়াসে অসাধ্য সাধন ও করা সম্ভব। মহিষাদলের রথের মেলায় এলে একটা জিনিস খুব ভালোভাবে উপলব্দি করা যায়। রাজপরিবারের যাবতীয় বৈভব আজ অস্তমিত, দুর্গাপূজার আড়ম্বড় ও আজ বিলীয়মান, কিন্তু মহাকালকে অগ্রাহ্য করে, জনসাধারণের স্বতস্ফূড়ড়ত যোগদানে মহিষাদলের রথযাত্রা আজও প্রাণবন্ত ও আনন্দোচ্ছল।

১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রানি জানকী দেবী মহিষাদল রাজবাড়ির রথযাত্রার প্রচলন করেন। শুধুমাত্র মেদিনীপুর নয়, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যমন্ডিত ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের মধ্যে এটি অন্যতম প্রধান উৎসব। দুই শতক পার করে আজও এই উৎসব ও মেলার আকর্ষণ অম্লান। হাজার হাজার  মানুষ গভীর আগ্রহ নিয়ে সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকেন কবে হবে মহিষাদলের এই রথের মেলা। এখানকার মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি থেকে ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে মেলা উপলক্ষে। দূর-দূরান্ত থেকে দলে দলে লোক আসে মেলা দেখতে। চারিদিকে এত যে অভাব,অনটন, তাতে কিন্তু মেলার উৎসাহে কোনো খামতি নেই। একমাসব্যাপী এই মেলায় জনস্রোত থাকে অবিরাম, অব্যাহত।  প্রকৃতপক্ষে গোটা অঞ্চলেরই অর্থনীতি এই মেলার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল।

মহিষাদলের রাজবাড়ির রথে কিন্তু শ্রীজগন্নাথ।দেব আরোহন করেন না। আরোহন করেন   মহিষাদল রাজবাড়ির কুলদেবতা মদনগোপাল জীঊ। ঠিক যেমন পূর্ববঙ্গের অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশের ধামরাইয়ের রথে আরোহন করেন যশোমাধব। আবার পুরী, বারিপদা বা মাহেশের রথের অধিপতি শ্রীজগন্নাথ। তবে নাম যাই হোক সবই সেই এক পূর্ণ ব্রহ্মের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ, যাঁর চরণে ভক্ত উজাড়  করে দেয় প্রাণের আকুতি।[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *