মহীরুহ

মহীরুহ

March 15, 2018

[:bn](বিষয়বস্তু : জীব সেবাই মানুষের প্রকৃত ধর্ম )

ঠক ঠক ঠক। কলিংবেলের শব্দে বেজে দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। শুনশান এই ছোট্ট মফস্বল শহরে এখন প্রায় রাত এগারটা। পৌষের ঠান্ডায় লেপমুড়ি দিয়ে গোটা শহরটাই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাক্তার গিন্নি কেবল রান্নাঘরে টুকটাক কাজ সারছিলেন দ্রুত হাতে। কাল সকাল সকাল ডাক্তারবাবু একটু সদরে যাবেন তাই প্রাতঃরাশের ব্যবস্থাটা গুছিয়ে দিয়ে শুতে যাবেন স্থির করেছেন। দরজায় করাঘাত এর শব্দ তার কানে পৌঁছল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত হল। এত রাতে কে?
ঘুম চোখে দরজা খুলে ডাক্তারবাবু দেখেন হনুমান টুপি, মাফলার আর সস্তার চাদরে ঢাকা এক রোগা ক্ষয়াটে চেহারার লোক। আগে কোনোদিন এটি দেখেছেন বলে মনে পড়ছে না। গম্ভীর গলায় জানতে চাইলেন, ‘কি চাই?’
‘আজ্ঞে আপনি তো একজন চিকিৎসক। চিকিৎসার প্রয়োজনেই আপনার কাছে আসা।’
‘ আপনি তো বেশ সুস্থ। এমন কি প্রয়োজন পড়ল যে আপনাকে এত রাত্রে ছুটে আসতে হল?’
বিনয়ের সঙ্গে সে বলে ওঠে, ‘না ডাক্তারবাবু, প্রয়োজন আমার নয়। ওই ওখানে গাড়িতে যে শিশুটা পড়ে আছে ওর।’ ভালো করে চোখ ঘষে ডাঃ হেমপ্রভ সরকার দেখলেন তাঁর বাড়ির ছোট্ট গেটটার বাইরে একটা গাড়ি–না না গাড়ি বললে ভুল হবে। একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যানের চারকোণে চারটি বাঁশ বেঁধে মাথাটা ফাইবার সিট্ দিয়ে ঢাকা আর গায়ে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ছোট দেওয়াল করা। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বেশ কটা লাল ক্রস চিহ্ন তাঁর চোখে পড়ল। হেসে ফেললেন তিনি। বললেন, ‘ওটা কি ? আপনার তৈরি এম্বুলেন্স?’
‘না না ডাক্তারবাবু, আমার কি সাধ্যি আছে যে এম্বুলেন্স বানাব ! ওটা আমার দুটো ভ্যানের একটা। পেটের প্রয়োজনে একটা ভ্যান চালাই আর অন্যটাকে গ্রামের দুস্থ,অসুস্থ , আর্ত মানুষের জন্য ব্যবহার করি। দ্রুত পায়ে ভ্যানের কাছে যান ডাক্তারবাবু। বছর সাত -আটের একটি বালক শুয়ে আছে। মুখে গ্যাঁজলা ঝরছে, পায়ে শক্ত করে বাঁধা কাপড়ের পট্টি। আগে বুঝতে পারেননি, ভ্যানের মধ্যে একটি অল্প বয়সী বিধবা বসে আছে, কান্না মেশানো অস্ফুট শব্দে সে বলে, ‘আমি ওর মা, ওরে বাঁচান ডাক্তারবাবু।’
ছেলেটাকে সাপে কামড়েছিল। ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে, প্রতিষেধক ঔষধ দিয়ে, মার কোলে প্রাণ ফিরে পাওয়া সন্তান সমর্পণ করলেন ডাঃ সরকার।হঠাৎ ওই ভ্যানচালকের কথা মাথায় এল, গেল কোথায় লোকটা? বিধবাটি বলতে লাগল, ‘ও তো ডমুরুদা। ডাক্তারবাবু, ও আমাদের কাছে লোক নয় গো দেবতা। ইখান থেকে অনেকদূরে গেরাম আমাদের। আমাদের পাঁচ পাঁচটা গেরামে রাস্তা ভালো নাই, আলো নাই, ঐ মানুষটারও নিজের বলতে কেউ নাই। না বাপ্ না মা ,সাতকুলে কেউ নাই ।থাকার মধ্যে আছে দুটো ভ্যান। একটায় লোকে চড়ে আর অন্যটারে ডমুরুদা এই কাজে লাগায়। অর্ধেক রাতেও তো মানুষটা ঘুমোয় না, শুধু সবার বিপদে ছোটে। তাইতো ও ঐ গ্রামগুলোর দেবতা। এমন লোক ক -জনা হয় গো ।’ কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখ ছাপিয়ে জল পড়তে লাগল। ডাঃ সরকার নিজেও বেশ প্রভাবিত হলেন।


বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। সেদিন ডাক্তার সরকার এক ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বর্ডারের প্রায় কাছে মরিচডা গ্রামে গেছেন। অনেকখানি রাস্তা তাঁর বাড়ি থেকে। রাস্তার অবস্থা বড়ই করুণ ,বেশিরভায় রাস্তাই কাঁচা,ভাঙাচোরা । ফেরবার পথে, হঠাৎ তার গাড়িখানা পরল এক গাড্ডায় । শত চেষ্টা করেও তিনি সেটা তুলতে পারছেন না অবশেষে স্থানীয় কিছু কিশোর হাত লাগিয়ে তার গাড়িটিকে ফেলল রাস্তায়। এরপরই সবে গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবেন, এমন সময় একটি বালকের দিকে চোখ আটকে গেল।বড় চেনা লাগছে মুখটা– কোথায় যেন দেখেছেন। হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ছেলেটি, মাস আটেক আগে রাতে চিকিৎসার জন্য এসেছিল। হাত নেড়ে ডাকলেন, কথা বলে বুঝলেন এই -ই সে। ডমুরুর কথা মনে পড়ে গেল। ছেলেটির সঙ্গে চললেন ওর ঠিকানায়।
একটা মাটির দোচালা কুটির। সামনে কিছুটা দাওয়া। তার সামনে ওর সেই বিখ্যাত এম্বুলেন্স আর অন্য একটা ভ্যান রাখা। দাওয়ায় হাওয়ায় চার-পাঁচটি শিশু বড় একটা কলাইয়ের গামলায় দেখা মুড়ি আর বাতাসা খাচ্ছে। বালকটি আওয়াজ দেয়, ডমুরুদা ও ডমুরুদা।’
কেডা রে ?
সস্তায় ধুতি খাটো করে পড়া সেই ক্ষয়াটে চেহারা , হাতে কোদাল ,হাঁটু অবধি মাটি মাখা –বোধ হয় পেছনের জমি কোপাচ্ছিল। ডাঃ সরকারকে দেখে প্রথমটায় অবাক চোখে চাইছিল, তারপরেই চোখে ঝিলিক খেলে গেল।
‘আপনি এসেছেন ডাক্তারবাবু ! কি সৌভাগ্যি ! ওরে বাবুরে দাওয়ায় একটা আসন পেতি দে নারে।’ শিশুর দল আসনের সন্ধানে হট্টগোলে মাতল। অবশেষে বালকটি ঘরের মধ্যে গিয়ে জীর্ন কিন্তু পরিষ্কার আসন পেতে দিল। ডাঃ সরকার জিজ্ঞাসা করলেন,’ তোমার তো নিজের কেউ নেই। তা এই শিশুরা?’
‘আমাদের এদিকের গ্রামগুলোয় বড় অভাব। তারপর গেলবার খানতিনেক গ্রাম বন্যায় ডুবেছিল। কি কষ্ট বাবু ! কারো বাপ -মা গেল, তো কারো সন্তান। এই পাঁচটা বাচ্চা বাপ-মা মরা অনাথ। দুবেলা ওদের খেতি দেবার কেউ নেই। আমি একা মানুষ – বাপ-ঠাকুর্দার কিছু জমি-জমা আছে, তাছাড়া ভ্যান টেনে যেটুকু রোজগার করি চারবেলা পেটে দিয়েও কিছু থাকে। তাই থেকে ওদের একটু দিই।’
বিস্ময়ের বাকরুদ্ধ ডাঃ সরকার। মফস্বলের নামি ডাক্তার তিনি। অর্থ ভালোই রোজগার করছেন অথচ এমন মহৎ কাজের কথা কোনদিন তিনি ভাবেননি। ‘ডাক্তারবাবু নিন ধরেন’। তাকিয়ে দেখেন হাতে একটা বড়সড় ডাব কেটে এনে ডমরু দাঁড়িয়ে আছে। হেসে ফেললেন তিনি। ডাবের জলে পিপাসা মিটিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমার এম্বুলেন্স-এর খবর কি?’
‘ আজ্ঞে এই পাঁচখানা গেরামে কোনো স্বাস্থ্য কেন্দ্র নাই ডাক্তারবাবু। তাই বলে রোগীদের চিকিৎসে হবে না ! তাই ভ্যান সার্ভিস তো দিতেই হবে।’
‘সে নয় হল। কিন্তু তার সঙ্গে তুমি আরো অনেক সার্ভিস দিচ্ছ। যেমন ধরো এই অনাথ বাচ্চাগুলোর দায়িত্ব।’
ডমরু জীভ কেটে তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে।— কী যে বলেন ডাক্তারবাবু ,এ আর এমন কি ? আসেন না, দেখে যান আমার সবজি ফলের বাগান, ধানজমি। ডাঃ সরকার ঘুরে আসেন সবজি ফলের বাগান আর ধান জমিতে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিশ্চয় লোকটা। অপূর্ব সেই সবজির ক্ষেত পুই, পালংশাক থেকে শুরু করে আলু কপি মূলো সবকিছুই আছে। ওপাশে পেয়ারা, সবেদা, আতা ,কলা আর নারকেল গাছের সারি। নিজেই ঘরে সার তৈরি করে গাছে দেয়। বিনা কীটনাশকে তৈরি সবজি ফল— উনি ভাবেন নাগরিক জীবনের অনেক বাচ্চার থেকে খাঁটি খাবার খেয়ে এরা বড় হচ্ছে। হোক না অনটন তবুও। তার সঙ্গে বাড়তি পাওনা এমন স্নেহ ভালোবাসা।
ফিরে এসে ডমরুর ঘর দেখতে ঢুকলেন। ঘরে সামান্য একটা চৌকি আর একটা মিটসেফ। মাটির দেওয়ালে কিছু কাঠের তাক আর তাতে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা আর প্রাথমিক শিক্ষার বই। তাৎক্ষণিক চিকিৎসার কিছু ওষুধও দেখলেন। বুঝলেন দরকার পড়লে নিজেই আজকাল ব্যবহার করে রোগীদের ওপর। কিন্তু পড়ার বই গুলো কিসের জোন্যে জিজ্ঞাসা করতে উত্তর পেলেন।
মরিচডা গ্রামের নিম্নবুনিয়াদি প্রাথমিক স্কুল তার প্রধান শিক্ষকও ডমরুর কাজকর্ম দেখে তাকে বিশেষ স্নেহ করেন। মাসতিনেক তিনি অবসর নিয়েছেন। তারপর নিজেই ডমরুর দাওয়ায় বসে সপ্তাহে দিনতিনেক দুপুরের দিকে, গ্রামগুলির বাচ্চাদের অবৈতনিক শিক্ষা দান করেন। যত শোনেন ডাঃ সরকারের মুগ্ধতা বাড়তে থাকে। নিতান্ত গরিব ঘরের একটি ছেলের পক্ষে এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মানুষের এত সেবা করা সম্ভব ! ডমুরুকে বলতেই একগাল হাসি নিয়ে বললে, ‘কি যে বলেন, জীবসেবা যে সেবা পরম ধর্ম।’

বিকেলের আলো পড়ে আসছে। এতটা রাস্তা নিজেকে ড্রাইভ করে যেতে হবে। তাই উঠে পড়লেন ডাঃ সরকার। মাটির দাওয়ার ওপরে চোখ পড়তেই দেখলেন শতছিন্ন ছাউনি। কোনো দ্বিধা না করেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ডমরু, এখান থেকে রোদ বৃষ্টি সবই অক্লেশে তোমার এই দাওয়ায় ঢুকে পড়ে। তা বাচ্চাগুলো যখন পড়াশুনা করে, খায় দায়, তাদের অসুবিধা হয় না?’
‘তা একটু হয় ডাক্তারবাবু। তবে জোর ছোটাছুটি করে গ্রামে আলোর ব্যবস্থা করি ফেলেছি। নতুন ভি ডি ও সাহেব বড় ভালো লোক। আগামী বছরের গোড়াতেই গ্রামে ইলেকট্রিক আসবে। তখন নয় জোগাড়যন্ত্র করি ঘর মেরামত করব।’
ভীষণ অনুশোচনা হচ্ছে তাঁর নিজের। কতদিন আগে এই মানুষটার সঙ্গে আলাপ। যদি যোগাযোগ রাখতেন, কিছু করতেন এরকম মহৎ উদ্যোগীর সাহায্যের জন্য। পকেটের মধ্যে হাত দিয়ে টাকার ব্যাগটা বের করতেই ডমরু দ্রুত দু’হাত দিয়ে তার হাত চেপে ধরল। ভিজে গলায় বলল, না না বাবু , এটি করবেন না। আমি টাকা নিতে পারব না বাবু। আমার অভাব, টানাটানি আছে ঠিকই কিন্তু কাজের আনন্দও আছে। আপনি আমায় আশীর্বাদ করুন যেন এই ভাবেই আমি জীবসেবা করতে পারি। এ যে আমার ইহকালের পুণ্যি ডাক্তারবাবু ।
‘ কিন্তু ডমরু, তোমার ডাক্তারবাবুরও যে বড় পূন্যপ্রাপ্তির ইচ্ছে ঘটেছে। তার কী হবে?
হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ডমরু। ডাঃ সরকার দেখেন মাটির ঘরখানির পাশে কাঠা দুই ফাঁকা জমি। জিজ্ঞাসা করে জানেন ওটা ডমরুর পৈতৃক জমি।
‘শোনো ডমুরু মরিচডা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের মতো আমিও তোমাকে বিশেষ ভালোবেসে ফেলেছি। তাই আমার আবদার তুমি ফেলতে পারবে না। টাকা তোমায় নিতে হবে না, কিন্তু এই ফাঁকা জমিতে আমি পাকাঘর বানাবো। একদিকে অবৈতনিক পাঠশালা সেখানে বাচ্চারা পড়বে আর অন্যদিকে অবৈতনিক চিকিৎসাকেন্দ্র যেখানে সপ্তাহে দিন চারেক এসে এই কটি গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করব।’
‘ কি বলছেন বাবু, অতদূর থেকে আপনি আসবেন এখানে, এত দয়া আপনার !’
‘দয়া বলছ কেন? তুমি যদি এমন সেবা করতে পারো তবে আমি একজন চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে পারব না। হ্যাঁ ,প্রথম প্রথম হয়ত একটু বেশি পরিশ্রম করতে হবে তবে তার সুফলও ব্যাপক।
দু’হাত জোড় করে হাটু ভেংগে ডাঃ সরকারের সামনে বসে পড়ে ডমরু। তার চোখে আনন্দঅশ্রু । হাত ধরে তাকে বুকে তুলে দেন ডাঃ সরকার । এই নিঃস্বার্থ সেবাব্রতী কে দেখে তিনি শুধু মুগ্ধই হন না, বয়সে বড় হয়ে মনে মনে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানান। এখন ওকে আর ক্ষয়াটে, ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে না—-মনে হচ্ছে এক বিরাট মহীরুহ, যার ছাওয়ায় শুধু এই পাঁচটা গ্রাম নয় তিনি নিজেও আশ্রয় নিয়েছেন।

মনীষা ভট্টাচার্য

(বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত স্মৃতি-সাহিত্য প্রতিযোগিতায় ১ম পুরস্কৃত গল্প )

[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *