[:bn]মা খুব দুষ্টু[:]

[:bn]মা খুব দুষ্টু[:]

July 16, 2018

[:bn]

সুজিত কুমার বসাক

তিড়িং তিড়িং করে দিব্যি খেলছে ওরা। মিনি তো হেসেই বাঁচে না। তিনটে চড়ুই ক’দিন হল মিনিদের দোতলার জল বেরুবার পাইপটার মধ্যে বাসা বেঁধেছে। অবশ্য এ পাইপটা এখন আর ব্যবহার করা হয় না। পাশেই  আর একটা নতুন পাইপ লাগানো হয়েছে। পুরোনোটা যেকোনো দিন খুলে ফেলবে হয়তো। কিন্তু মিনি ঠিক করেছে ওটা কিছুতেই খুলতে দেবে না। কী সুন্দর বাসা বানিয়েছে ওরা ওর মধ্যে! মানুষের মতো ওটাই ওদের বাড়ি। মিনির খুব ইচ্ছে করে ভেতরটা দেখতে। কী আছে ওদের বাড়িতে? কিন্তু দেখবার তো কোনো উপায় নেই। ও জায়গায় যাবে কেমন করে? যদিও বা কেউ যেতে পারে, কিন্তু মিনির পক্ষে অসম্ভব।ও তো অন্যদের মত নয়। ওর পায়ের জোর খুব কম। হাঁটতেই যে পারে না সে আর কেমন করে যাবে ওখানে?

দুটো বড় চড়ুই। বর- বউ। আর একটা ছোট বাচ্চা। তিনজনের সংসার ওদের। দিনের বেলায় খাবারের সন্ধানে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় তার কোন ঠিকঠিকানা নেই। মাঝে মাঝে ফিরে আসে। পাইপের ওপর তিড়িং তিড়িং লাফিয়ে খেলা করে। বাচ্চাটাকে উড়তে শেখায় দুজনে। সে বড় মজার খেলা। মিনি খিলখিল করে হাসে ওদের রঙ্গ দেখে।

কখনও কখনও ওরা উড়তে উড়তে মিনির জানালার ওপর এসে বসে। মিনি ভাবে পাখির ভাষা যদি   শেখা যেত তাহলে ওদের সঙ্গে ভাব করে নেওয়া যেত। কত গল্প করা যেত। কিন্তু মিনি জানে পাখির ভাষা শেখা যায় না। মাঝে মাঝে ভাবে মা হয়তো জানলেও জানতে পারে। তবুও জিগ্যেস করতে পারে না। কে জানে এমন অদ্ভুত কথা শুনলে মা হয়তো রেগেই লাল হয়ে যাবে।

পরক্ষণেই ভাবনাটাকে শুধরে নেয় মিনি। তার মা তো ভীষণ ভীষণ ভালো। মারধোর তো দূরের কথা কখনো বকেই না মা। কারণ মিনি অন্যায় কাজ খুব কম করে। ভীষণ বাধ্য মেয়ে সে। আর বাবা? বাবা তো মিনি বলতে অজ্ঞান। বাবাকে শিলিগুড়িতেই থাকতে হয় বেশিরভাগ দিন। সপ্তাহে একদিন করে বাড়িতে আসে। ফেরার পথে প্রতিবারই কত কিছু নিয়ে আসে। মিনি সবার মতো ছুটোছুটি করে খেলতে পারে না বলে বাবা ঘরে বসে খেলবার মতো কত্ত খেলনা এনে দিয়েছে। কিন্তু খেলার চেয়ে বই পড়তেই বেশি ভালো লাগে মিনির। আর এখন তার চেয়েও প্রিয় হয়েছে ওর তিন চড়ুই সাথী। ওদের সঙ্গেই কেটে যায় সারাটা দিন। একটু অন্ধকার হতেই ওরা সুড়ুৎ করে ঢুকে যায় ওদের ঘরের মধ্যে। তখন মিনি পড়তে বসে।

ওদের যে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে তা নিজে নিজেই একদিন টের পেল মিনি। সেদিন বউ চড়ুইটাকে দেখতে পাচ্ছিল না মিনি। প্রথমে ভাবল শরীর-টরির খারাপ- তাই হয়তো ঘরের মধ্যে রয়েছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হল- দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কিন্তু বর চড়ুই আর বাচ্চাটার উদ্বিগ্ন মুখ দেখেই মিনি বুঝে ফেলল বউ চড়ুই নিশ্চয়ই বিপদে পড়েছে। মুহূর্তের মধ্যে দুশ্চিন্তাটা মিনির মাথায় চেপে বসল। কোথায় গেল সে? এখনো ফিরছে না কেন?

অন্ধকার আর একটু গাঢ় হতেই কান্না পেয়ে গেল মিনির। কেঁদেই ফেলল মিনি। সেই সঙ্গে হাত জোড় করে প্রার্থনা করল, বউ চড়ুইকে এক্ষুনি ফিরিয়ে দাও ঠাকুর। মা মঙ্গলচন্ডী তুমি তো কতকিছু পার।

একদম সন্ধের মুখে হঠাৎ ফিরে এল বউ চড়ুই। বউ চড়ুইকে দেখে মিনির চোখে আবার জল। তবে এ জল আনন্দের। ওদের মিলন দু’চোখ ভরে  দেখে সেদিন পড়তে বসেছিল মিনি। পড়াতে মন বসেনি মোটেও। শুধু ওদের কথাই মনে পড়ছিল। অবশ্য ওই পড়াটা পরে পড়ে নিয়েছিল ভালোভাবে।

একদিন এক কাণ্ড ঘটে গেল। কান্ড তো কান্ড- একেবারে জব্বর কান্ড। মিনি সেদিন বাড়িতে ছিল না। পুপুমাসি ওকে রাজগঞ্জের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। পুপুমাসিরা রাজগঞ্জে নতুন বাড়ি বানিয়েছে। বাবা-মাও মিনির সঙ্গে গিয়েছিল কিন্তু বাবা-মা চলে এলেও মিনির আসা হয়নি। পুপুমাসি আসতে দেয়নি। বলেছিল, মেয়েটা সারাটা দিন ঘরে বসেই কাটায়, এখানে ক’টা দিন থেকে গেলে ভালো লাগবে। তাছাড়া পুপুমাসিকে মিনিরও খুব ভালো লাগে। মায়ের মুখটা পুপুমাসির মুখের সঙ্গে এতটাই মিল যে মনে হয় ওরা বুঝি যমজ বোন। আসলে কিন্তু তা নয়।

যাক সেসব কথা, এবার সেই কান্ডের কথা বলা যাক। মিনি তো বাড়িতে নেই সুতরাং চড়ুইদের আর কে খেয়াল করবে? রাজগঞ্জে বসে মিনি এসব কথা ভাবলেও আসলে কিন্তু মিনির বন্ধুদের প্রতি মায়ের দিব্যি নজর  ছিল। মা মুখে কিছু না বললেও চড়ুইদের নিয়ে মশগুল মিনিকে দেখে মাও তো অনেক আনন্দ পেয়েছে। চড়ুইদের তিড়িং তিড়িং লাফানো দেখে নিজেও অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে কত হেসেছে। তবে মিনির মতো খিলখিল করে নয়। মা কখনো জোরে হাসে না। তবু মায়ের হাসি কত্ত সুন্দর।

সেই হাসিখুশি মা যে কখনও অগ্নিমূর্তি হতে পারে সেটা তো ভাবাই যায় না। তাই বোধহয় কাজের লোক শিবেন মায়ের অমন অগ্নিমূর্তি দেখে কী ভয়টাই না পেয়েছিল।

মা অগ্নিমূর্তি হয়েছিল কেন? রাতে মা শিবেনকে একটু গরম জল করে আনতে বলেছিল, হাতের চেটোয় সেঁক দেবে বলে। চেটোতে একটু চোট পেয়েছিল। ব্যাথা ব্যাথা হচ্ছিল সেখানে। তাই ভেবেছিল গরম জলের সেঁক দিলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এদিকে দাদু খবর পেয়ে খোঁজ নিতে এসে বললে, কোথায় তোমার চোট দেখি? দাদু হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। দেখেশুনে বললে, ওখানে গরম জল লাগানো চলবে না, আমি লাগানোর অন্য ওষুধ দিচ্ছি।

সুতরাং গরম জল দিয়ে আর কী হবে? শিবেন ওটা ফেলে দিতে যাচ্ছিল পুরোনো পাইপ দিয়ে। তখনি মা অগ্নিমূর্তি হয়ে ছুটে এল শিবেনের দিকে। শিবেন তো শিবেন, দাদুও ভীষণ অবাক। ভয়ে দুজনার কেউই কারণটা পর্যন্ত জিগ্যেস করার সাহস হারিয়ে ফেলল। একটু পরে মা-ই সব খুলে বলল ওদের।

রাজগঞ্জে পুপুমাসির বাড়ি থেকে ফিরে এল মিনি।

সেই মা যে আজ সকালে এমন করে মিনির সঙ্গে মস্করা করলে যে মিনি কেঁদেকেটে একসার। তবে শেষে মায়ের মস্করাটা মজাদারই লাগল মিনির কাছে।

নাটকটা প্রথম শুরু করেছিল মা-ই। মিনি  ফিরতেই শিবেনকে ডেকে জোর গলাতে বলতে লাগল, তোকে না কতবার বলেছি শিবেন ওই পাইপটায় জল-টল ফেলবি না। কাল রাতে গরম জল ফেলেছিস শুনলাম। তোর কী কোনোদিন আক্কেল হবে না?

ব্যস, মিনির বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। হাহাকারের মতো গলায় আর্তনাদ করে উঠে বলল, কখন ফেলেছে?

রাতে হবে হয়তো। মা অবাক হবার ভান করে বলল।

ও মা, তখন তো ওরা শুয়ে থাকে। কেন তোমরা ওদের মেরে ফেললে? মিনি কাঁদতে শুরু করল।

মা মুখ টিপে হেসে বলল, আয়।

তারপর হাত ধরে জানালার কাছে নিয়ে গেল। কী দেখলো মিনি? দেখল তিন চড়ুইয়ের তিড়িং তিড়িং। কান্না- হাসি মেশানো মিনি মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি খুব দুষ্টু।

পিছনে শিবেনদাদা হাসছে। দাদুও কখন এসে দাঁড়িয়েছে। সেও হাসছে। মিনি বুঝল, তিনজনে মিলে ওকে বোকা বানিয়েছে। এবার মিনিও হেসে ফেলল।

[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *