[:bn]মোহনবাঁশি[:]

[:bn]মোহনবাঁশি[:]

January 24, 2018

[:bn]মদনমোহন তলার মুখটায় আসতেই শঙ্কর ঘেমে-নেয়ে একশা ।চৈত্রের রোদটা খুবই কড়া। এতটা বেলা হয়ে গেছে বিছানায় থাকতে বোঝাই যায়নি। আরো দুটো গলি ছেড়ে মিত্রদের বাড়ি। শঙ্কর গেলে পর গৃহদেবতা রাধামাধবের পুজো হবে তবে বাড়ির বুড়ি গিন্নি নিস্তারিণী দেবী জল খাবেন। নাঃ ,কাল থেকে আরেকটু সকালে বিছানা ছাড়তে হবে। এত আলস্য করা চলবে না। এই কাজটাও যদি যায় তাহলে কপালে দুঃখ আছে । এই আলসেমির জন্য বাবার বাঁধা নিত্যসেবার কাজগুলোর মধ্যে টিমটিম করে গুটিকয়েক টিকে আছে ।ভালো ভালো ঘর সবই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে।
বাবা ছিলেন ডাকসাইটে নিষ্টাবান পুরোহিত। উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ি গুলির অনেক গুলিই ছিল তাঁর যজমান।ঠাকুর মশাই বলতে সবাই অজ্ঞান। দূরদূরান্ত থেকেও বাবার ডাক আসত। বড় বড় কাজে বাবাকে সাহায্য করার জন্য শঙ্করকে সঙ্গে যেতেই হতো। তখনই সে দেখেছে বাবার প্রতিপত্তি। বাবার থেকে বয়সে বড় মানুষজন পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত।
শঙ্করের চোখ ধাঁধিয়ে যেত ওইসব ধনী বাড়ির জাঁকজমক দেখে।বিশেষ উপলক্ষে সিন্দুক থেকে বেরোত দামি বাসন, গয়না, কাপড় । শঙ্করের সেসব দেখতে এত বেশি ভালো লাগতো যে নৈবিদ্য রচনায় গলদ ধরা পড়ত । বাবা অসন্তুষ্ট হতেন ।শঙ্করকে প্রায়ই বলতেন ,ধন- দৌলত দেখে আত্মহারা হও কেন ? তুমি কত অমূল্য ধনের অধিকারী একবার ভাবো তো। ব্রাহ্মণ হল বর্ণশ্রেষ্ট । বিদ্যায় -বুদ্ধিতে সকলের সেরা। এই যে সমাজে যত নিয়ম কানুন সবই ব্রাহ্মণ-এর বিধান। এই সব জ্ঞানের কথায় কোনদিন মুগ্দ্ধ হয়নি। তার কাছে আসল কথা হল টাকা। ওসব চলত আগেকার দিনে। এখন সম্মান প্রতিপত্তি হয় টাকার জোরে।
বাবা বলতেন কর না টাকা, কে বাধা দিচ্ছে? কিন্তু অন্য মূলধন যখন নেই তখন দরিদ্র ঘরের সন্তান বিদ্যাকেই মূলধন করে এগোয় । তাতে সম্মান ও স্বাচ্ছন্দ দুই পাওয়া যায়।

 

বাবার কথা শুনলে আর জীবনটা অন্যরকম হতো। কোন কিছু শেখার জন্য পরিশ্রম করতে তার কোন দিন ভাল লাগেনি। এই আলস্যের জন্য জীবনে যা কখনও ভাবেনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেই কাজই করতে হচ্ছে। বাবা- ঠাকুরদার কাছে যা ছিল অত্যন্ত সম্মানের বংশকাজ ,শঙ্করের কাছে তা নিরুপায় বেগার ঠেলা ।
বাবা নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, এত চাহিদা ভালো না। নিজের অবস্থার কথা মাথায় রেখে চলো । দরকার হলে উপোস করবে।
সম্মান ,সততা বাবার কাছে বড় ছিল বলে মুখে উপোসের কথা বললেও বাবা বেঁচে থাকতে শঙ্কর কোনদিন খাওয়া-পরার কষ্ট পাইনি যেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।একদম অনিচ্ছায় করে বলে কাজে মন নেই ।কথার খেলাপ ও দায়িত্বহীনতার জন্য ভালো ভালো ঘরগুলো চলে গিয়েছে।দু -একটা নিত্যসেবার কাজ আছে তার থেকে মোটা ভাত কাপড় টা কোন রকমের হয়ে যায়। কিন্তু অন্যান্য প্রয়োজনী মেটে কই ? বড় বড় পুজো জাগো দুর্গা লক্ষ্মী কালি সরস্বতী এরকম সময়ে পুরোহিতের চাহিদা বাড়ে বলে শঙ্কর কয়েকটা কাজ পায় । কিন্তু সে তো বছরে মাত্র কয়েকবার।
নিস্তারিণী দেবী উদ্বিগ্ন হয়ে ও জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, শরীর ঠিক আছে তো? এত দেরী হলো তাই ভাবছি অসুখ করলো কিনা।
শঙ্কর কিছু বলবার আগে নিস্তারিণীর বিধবা মেয়ে শিবানী ঝংকার দিয়ে বলে উঠলো,অসুখ না ছাই ।উনি তো দিন দিন আসার সময় পিছিয়ে চলেছেন । আগে আসতেন সাতটায় ,আজ এলেন নটায় । কোন বাড়িতে গৃহদেবতা ন’টা পর্যন্ত শুকিয়ে আছে দেখাও দেখি। এমন করলে আমি অন্য্ ঠাকুরমশাই ঠিক করব, এই বলে দিলাম।

 

 

নিস্তারিণী ভারী ভালোমানুষ। শঙ্করের গম্ভীর মুখ দেখে বললেন, ও পাগলের কথায় তুমি কিছু মনে করো না। দেখো না নিজের একগাদা গয়না ভেঙ্গে কৃষ্ণের সোনার বাঁশি করাতে দিয়েছে। পূজোয় অনিয়ম ও সহ্য করতে পারেনা।
শঙ্কর চট করে বানিয়ে একটা মিথ্যা খাড়া করে, কি করবো বলুন? কদিন ধরে জলের কি অসুবিধে। চান না করে কি পুজোয় বসতে পারি? ওই জলের জন্যই রোজ দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই তো ভারি মুশকিল দেখছি। তুমি বাবা এক বালতি জল ধরে রেখো। নয়তো জান তো মেয়ের বড্ড মাথা গরম। তোমাকে না হক দুটো কথা শুনিয়ে দেবে। তোমাদের সঙ্গে কি আজকের সম্পর্ক? তোমার ঠাকুরদা পর্যন্ত পুজো করে গিয়েছেন এখানে । পুজো শেষ করে শঙ্কর রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে কুমোরটুলির দিকে হাঁটতে থাকে ।গঙ্গার ধারে পাশাপাশি দুটো ময়দার কলে গনেশ পুজো আছে। তারপর সরকার বাড়ি লেনের এক বাড়িতে নতুন কাজের ব্যাপারে কথা বলতে যাবার কথা আছে। রাস্তাঘাট তেতে উঠেছে। প্রতিটা জায়গাতেই দেরির জন্য কৈফিয়ত দিতে হবে মনে করে শঙ্করের আরো বিরক্ত লাগছিল। বেশ আছে বড়লোকেরা। কোনো ভাবনা চিন্তা নেই। কেবল হুশ হুশ করে গাড়ি করে চলে যাচ্ছে।
নতুন কাজটা হল না। সারা দিন কোনো কাজ নেই।সরকার বাড়ি লেনটা সোজা গিয়ে পড়েছে গঙ্গায়। সরু গলির দু’ধারে জরাজীর্ন পুরনো সব বাড়ি । বাড়িগুলোর খিলান বারান্দা গম্বুজ সবেতেই পায়রার বাসা। ছায়ার ঢাকা ঠান্ডা গলিটা থেকে বেরিয়ে শঙ্কর সোজা গিয়ে পড়ল জমজমাট বিচালি ঘাটে। বিশাল বিশাল খড় বোঝাই নৌকা এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে । পাশের ঘাটে যাত্রীরা অপেক্ষা করছে লঞ্চের জন্য। গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে শঙ্কর ভাবতে লাগল টাকা পয়সা থাকলে জীবনটা সে আরামে বসে কাটিয়ে দিতে পারত। চটকা ভাঙ্গলো কাঁধে চাপড় পড়ায় : কি রে এখানে বসে বসে ধ্যান করছিস নাকি?

 

শংকর তাকিয়ে দেখলো তাঁর সঙ্গে স্কুলে পড়তো রজত ও আরও একজন, তাকে চিনতে পারল না। দুজনে দামি জামা-জুতো দেখে নিজের আধময়লা সস্তা জামাকাপড়ের জন্য শঙ্করের রীতিমতো লজ্জা করতে লাগলো।
রজত চা -ওলার থেকে তিনটে চা নিয়ে জমিয়ে গল্পও শুরু করে দিলো। সঙ্গের ছেলেটিকে সে খোকন বলে ডাকছিল। সে ওদের কথা শুনল বেশি, বলল কম । একবার শুধু খোকন জিজ্ঞেস করলো পুজো করার সুবাদে তুমি তো দেখছি এইদিকের পুরনো অনেকগুলো বাড়ি চেন । অন্দরে যাবার সুযোগ হয়নি। বেশিরভাগ ঠাকুরঘরই ছাতেরওপর বা দালানে । ওই পর্যন্তই যাতায়াত । ঠিক আছে । দরকার হলে তোমার সাহায্য নে ব। খোকনের কথা শুনে বোঝা যায় তার ‘না’ শোনার অভ্যাস নেই। এরপর রজত ,খোকন আর শঙ্করের প্রায়ই দেখা – সাক্ষাৎ হতে লাগল। ঘনিষ্ঠতা আরেকটু বাড়লে পর রজত একদিন বলল, তোমার এখন যা অবস্থা তাতে তো তুমি সন্তুষ্ট নও মনে হয়। কি করা যাবে? সবাই তোর রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় না। তাই যেটা জুটেছে সেটাই করছি। জীবনেও অবস্থার পরিবর্তন হবেনা। এ কখনোও ভালো লাগতে পারে? সামান্য বুদ্ধি খরচ আর অল্প ঝুঁকি নিলেই কিন্তু তুমি অবস্থা ফিরিয়ে ফেলতে পার,রজত বলল খুব শান্ত ভাবে। কি করে ?

দেখ তোমাকে বিশ্বাস করে খুলেই বলছি সব। আমি আর খোকন ব্যাংক ডাকাতির দলে ছিলাম। এছাড়াও ঝোপ বুঝে কোপ মেরে নানা মওকায় ভালোই টাকা কামিয়েছি । এখন হাওয়া একটু গরম । তোমার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম তোমারও টাকার দরকার। এখন আমরা তিনজন মিলে কিছু একটা করতে পারি।
আমাকে কি করতে হবে? চুরি- ডাকাতি কিন্তু করতে পারব না। ওসবকিছুই করতে হবে না, এবারে খোকন হাল ধরে। তোমার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি এসব পুরোনো বাড়ির ঠাকুরঘরগুলি একেবারে স্বর্ণখনি। তুমি শুধু কোথায় কি থাকে , কিভাবে যেতে হয় বলে দেবে । বাড়ির লোকেদের বিষয়ও জানাতে হবে। বাকি কাজ করব আমি ও রজত । তোমার সঙ্গে আমাদের যে যোগ আছে তা ঘুণাক্ষরেও কেউ কল্পনা করতে পারবে না। এতটাই সোজা । এখন তুমি রাজি হলেই হয় ।

               শঙ্করের চোখের সামনে বিভিন্ন বাড়ির গৃহদেবতার মূর্তি ভেসে উঠলো। প্রতিটা ঠাকুরঘরে দামি দামি কাঁসা-পিতলে বাসন। প্রণামীর সোনার মোহর, রুপোর টাকা,  কত বছর ধরে দেবতাকে মানত করে দেওয়া অলংকার, সব এক মুহূর্তে মনে পড়ে গেল। কত ছোটবেলা থেকে ঠাকুর্দা -বাবার  হাত ধরে বাড়িগুলোতে গিয়েছে । বাবা পূজো করলে সে পাশে থেকেছে বা সাহায্য করেছে। আজও যজমানেরা তাকে বিশ্বাস করে। বাপ-ঠাকুর্দার উত্তরাধিকারী বলে বাড়তি মনোযোগ দেয়। কিন্তু লোভ এমন জিনিস কখন যে তার ছায়া আস্তে আস্তে মানুষকে গ্রাস করে ফেলে তা সে নিজেও বুঝতে পারে না। নানা কুযুক্তি খাড়া সে নিজের আচরণকে সমর্থন করতে থাকে।

                            শঙ্করেরও ঠিক সেই অবস্থায় হলো। সে ভাবল দেবতা তো মাটির, পাথরের তৈরি। গয়না, টাকা, বা মোহর কি তারা ভোগ করতে পারে? এ শুধু মানুষের কল্পনা । মানুষ দেবতাকে দামি জিনিস নিবেদন করে এসেছে বছরের পর বছর । কেউ সে সব খুলেও দেখে না। কারও কোনো কাজে লাগে না। যাদের উপচে পড়া বাড়তি টাকা আছে তারাই দেবতাকে নিবেদন করে দামি জিনিস।
এসব চিন্তা করার পর শঙ্করের মনে আর কোনো পাপবোধ রইল না। সে তার নিজের মনকে বোঝালো — আমিও দেবতার সেবা করে এসেছি এত বছর। তার উপযুক্ত দক্ষিণা হিসেবে এর কিছুটা দাবী করতেই পারি।

এরপর তিন মূর্তির অভিযান শুরু হল। শঙ্করের থেকে খোঁজ খবর পেয়ে রজত ও খোকন সুযোগ বুঝে হাজির হয়ে  মুহূর্তের মধ্যে কাজ সেরে হাওয়া হয়ে যায় । কয়েকমাসের মধ্যে উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়ির ঠাকুরঘরগুলোতে পরপর হানা দিয়ে এরা বেশ ভালোরকম কামিয়ে নিল।

        প্রতিবছর দোলপূর্ণিমাতে নিস্তারিণী দেবী ঘটা করে রাধা-মাধবের পুজো দেন।  সেইজন্য শঙ্কর একটু সকাল সকালই এসেছিল। ঠাকুরঘরে ঢোকা মাত্র শঙ্করের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কৃষ্ণের হাতের সুন্দর কারুকাজ করা বাঁশিটি পাক্কা দশ ভরি হবে। কালো কষ্টি পাথরের মূর্তির হাতে সোনার বাঁশিটি যেন এক্ষুনি বেজে উঠবে বলে মনে হচ্ছে। শঙ্কর নিস্তারিণীকে ইচ্ছে করে বলল, এত দামী জিনিস পুজো শেষে তুলে রাখাই ভালো।                                                                                                                                   নিস্তারিণী হেসে বললেন ,না বাবা, রাধা-মাধবের জন্য করিয়েছি  সিন্দুকে তুলে রাখব কেন? যাঁর জিনিস তিনিই রক্ষা করবেন।

   শংকর শুনে মনে মনে বেশ খুশি হলো। একটু বুদ্ধি খাটালেই এবাড়ির ঠাকুর ঘরে ঢোকা এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়। ঠাকুর ঘরের পাশে রাস্তার ধারের বারান্দার গায়ে একসারি জানালা। তিনতলা বলে তাতে কোনো গারদও নেই। সব কটা জানালা খুলে দিলে রোদ , আলো-হাওয়ায় ঠাকুর ঘর ভেসে যায়। দরকার না হলে জানালাগুলো খোলা হয়না। কোনো এক রাতে কিছু ফেলে গেছি এই ছুতোয় যদি ঠাকুর ঘরে ঢোকে আর বারান্দার কোন একটা জানালার ছিট্কিনি খুলে চলে যায় তাহলে রজতরা খুব সহজেই কাজ হাসিল করতে পারবে। রাস্তা থেকে তিনতলা পর্যন্ত ওঠা ওদের কাছে জলভাত ।

সেদিন রাতে শঙ্কর বাবাকে স্বপ্নে দেখল। বাবা বলছেন, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু, এখনো সময় আছে, ফিরে আয়। বাবার পাশে ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, মা আরও কত চেনা অচেনা মৃত আত্মীয় পরিজন পূর্বপুরুষের মুখ । স্থির হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলে চলেছেন, ফিরে আয় ফিরে আয়।
ঘেমে নেয়ে গলা শুকিয়ে শঙ্করের ঘুম ভেঙ্গে গেল। জল খেয়ে ধাতস্ত হয়ে মনে হলো ভাগ্যিস, এটা স্বপ্ন। কেন যে সে এত ভয় পেয়ে গেছিল কে জানে? হয়ত অন্য বার শুধু খোঁজখবর দিয়ে দেয়, এবার নিজে উপস্থিত থেকে অংশ নেবে তার জন্য মনের ভেতর গোপনে একটা ভয়, একটা অস্থিরতা দানা বাঁধছে।হয়তো নিস্তারিণী এত স্নেহ করেন বলেই একটু বিবেকদংশনও হচ্ছে। শঙ্কর গামছায় মুখ মুছে সমস্ত ভাবনা চিন্তা গুলোকে ঝেটিয়ে বিদায় করল। একবার যখন শুরু হয়ে গেছে তখন ফিরে আসার কোন মানে হয়না। নাচতে নেবে কি কেউ ঘোমটা দেয় ?

ঠিক পরের আমাবস্যায় একটু রাত করে শঙ্কর নিস্তারিণীর বাড়িতে গিয়ে হাজির হল। সমস্ত পাড়া নিঝুম। হু হু করে বসন্তের বাতাস বইছে। শঙ্করের গলা শুকিয়ে উঠেছে। হাতের তালু ঠান্ডা ভিজে ভিজে — ঠিক জ্বর আসার আগে যেমন হয়।
নিস্তারিণী ও তাঁর মেয়ে সবে রাতের খাওয়া সেরে উঠেছেন, শঙ্কর গিয়ে কড়া নাড়ল ——খুব খারাপ লাগছে এত রাতে আপনাদের বিরক্ত করতে। ঠাকুরঘরে গীতাটা ফেলে গেছি। ছাতাটাও বারান্দার কোনে রেখেছিলাম । ওখানেই পড়ে আছে। ছাতা না হলেও চলত কিন্তু খুব ভোরে গীতাপাঠ আছে সেজন্য বাধ্য হয়ে আপনাদের বিরক্ত করতে হল। মেয়ে সত্যিসত্যি বিরক্ত হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, নিস্তারিণী তাকে থামিয়ে বললেন, তাতে কী হয়েছে,এ তো তোমার নিজেরই ঘরবাড়ি। এই যে চাবি, যাও নিয়ে এসো গিয়ে তোমার জিনিস ।                                                                                                                                                                   তিনতলার কার্নিশে দিকে তখন অন্ধকারে মিশে এগোচ্ছে দুই মূর্তি —- রজত আর খোকন । শঙ্কর জানে বেশি দেরি করা চলবে না। ঠাকুরঘরের তালাটা আলগা রেখে, বারান্দার একটা জানলার ছিটকিনি খুলে নেমে যেতে হবে। মা মেয়ে দোতলাতে শোয় । তিনতলা খালি থাকে। ওরা একবার ঢুকে পড়তে পারলে আর ভয় নেই।
তালা খুলে ঠাকুর ঘরে ঢুকেই শঙ্কর অবাক হয়ে গেলো। বাইরে অন্ধকার ঘুটঘুট করছে অথচ পূর্ণিমার চাঁদের মত আলোয় সমস্ত ঘর ভরে আছে । সে মুগ্ধ হয়ে এই অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করে করল খানিকক্ষণ। তারপর কি জন্য এসেছে সেটা হঠাৎ মনে পড়ায় পেতলের ঘড়ার আড়ালে রাখা গীতাটা তুলে যেই বেরোতে যাবে অমনি বাঁশিতে সুর বেজে উঠল। সে পিছন ফিরে দেখে পাথরের কৃষ্ণঠাকুর জীবন্ত হয়ে সোনার বাঁশিটি বাজিয়েই চলেছে । শঙ্কর তাকাতেই চারচোখে মিলন হল। সেই পাথরের চোখ দিয়ে স্নেহ -করুনা ঝরে পড়ছে, যেন বলছে, তুই পালাবি কোথায়? বাঁশির মায়াময় সুরে শংকর যেন ছোবল মারতে ভুলে যাওয়া এক সম্মোহিত সাপ। আবছা করে মনে পড়ছে, তার যেন কি করার কথা? কারা যেন তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কি যে করার কথা কারা বলেছিল কিছুই আর মনে পড়ল না।                                                                                                                                                রজত ও খোকন এদিকে এক মারাত্মক বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে। শঙ্কর ভেতরে গিয়েছে অনেক্ষন,ছিটকিনি খোলার নামগন্ধও নেই। এখন বাইরে থেকে জানালা ভাঙার প্রশ্নই ওঠে না। সেই প্রস্তুতিও নেই। এতক্ষন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে লোকের চোখ পড়তে বাধ্য। হলও তাই। পুলিশের একটা টহলদার গাড়ির জোরালো আলো আসে পড়ল তাদের গায়ে। তার সঙ্গে তীক্ষ্ন বাঁশির আওয়াজ । আর পালাবার উপায় নেই।
এদিকে ঠাকুরঘরে শঙ্কর এক অদ্ভুত মায়াময় সুরের জালে বন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । খানিক বাদে তার মনে হল এই জগত – সংসার সবই অলীক মায়া। তার ঘরবাড়ি নেই। সংসার নেই। কেউ কোথাও নেই। তার যুক্তি বুদ্ধি সব গুলিয়ে গেল। প্রাণভোলা বাঁশির সুর কানে নিয়ে শঙ্কর ভূতে পাওয়া লোকের মতো নিচে নেমে এল । নিস্তারিণী ও তার মেয়ে কি যেন বলছেন। রাস্তায় অনেক লোক। শঙ্কর শূন্য চোখে তাকিয়ে দেখল। তার মাথায় কিছুই ঢুকল না কারণ তার সমস্ত কান জুড়ে আছে সেই সোনার বাঁশির সর্বনাশা মন ভুলানো সুর। শঙ্কর সেই যে পথে বেরিয়ে এলো তার আর ঘরে ফেরা হলো না কোনদিন।
গঙ্গার ঘাটে উসকোখুসকো চুল একটা লোক দিন রাত বিড়বিড় করে বকে আর নতুন লোক দেখলেই জিজ্ঞেস করে শুনতে পাচ্ছ?
এটাই যে একসময় পূজারী ব্রাহ্মণ শঙ্কর ছিল তা আর বোঝার উপায় নেই।

   ঋতা বসু

[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *