[:bn]শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ[:]

[:bn]শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ[:]

January 24, 2018

[:bn]

প্রকৃতি – প্রমিক রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে মানুষের শিক্ষা যে সম্পূর্ণতা লাভ করে না – এ তিনি অন্তর দিয়ে অনুভব করতেন। এই অনুভবের তাগিদেই তিনি পিতার উপাসনা আশ্রম শান্তিনিকেতনে গড়ে তুলেছিলেন ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ নামক এক শিশু বিদ্যালয়।শিশুমনে গোড়া থেকেই প্রকৃতির স্বরূপ চিনিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
শান্তিনিকেতনের উন্মুক্ত প্রান্তরে অবারিত খোলা আলো -হাওয়া , দিগন্ত বিসতৃত শস্যশ্যামলা ধানক্ষেত, নিত্য পরিবর্তনশীল ঋতু বৈচিত্রের মাঝে বিদ্যা- শিক্ষাকে জীবনের শিক্ষা রূপান্তরিত করে দিয়েছিলেন ।
১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসে (বাং ৭ পৌষ ,১৩০৮ সাল )তিনি যখন শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন,তখন ভারতে পূর্ণমাত্রায় স্বাধীনতা আন্দোলন চলছে। সুদূর বোলপুরের নির্জন প্রান্তরে রবীন্দ্রনাথের এই শুভ প্রচেষ্টা ইংরেজ শাসকদের সন্দিহান করেছিল।আর ফলে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষালয়ে তৎকালীন বাংলার শিক্ষিত , অভিজাত ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ইংরেজ সরকারের রোষের ভয়ে নিজ নিজ পরিবারের সন্তানদের এখানে পাঠাতে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বুদ্ধ হননি । তাছাড়া, রবীন্দ্রনাথ নিয়ম করেছিলেন এই আবাসিক ব্রহ্মচর্য বিদ্যালযয়ে ১০ বছরের বেশি বয়সের ছেলেদের ভর্তি করা হবে না, কারণ শিশুমনের প্রকৃত গঠনপ্রণালী এই বয়সেই যথোপযুক্ত থাকে। এই সব নানা কারণেই সূচনাতেই রবীন্দ্রনাথের এই প্রচেষ্টা ধাক্কা খাওয়ার মুখে পড়লে তিনি পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের কাছে সাহায্যের প্রত্যাশায় কাতর আবেদন করেন। তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু ডেপুটি শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে সেই সময় লেখা তাঁর একটি আবেদনপত্র এইরকম :

“বন্ধু হে
পরিপূর্ণ বরষায়
আছি তব ভরসায
কাজকর্ম কর সায় –
এস চটপট ।
শামলা আঁটিয়া নিত্য
তুমি কর ডেপুটিত্ব
একা পড়ে মোর চিত্ত
করে ঝটপট।”

 

বন্ধু শ্রীশচন্দ্র তাঁর এই আবেদনে অধিকতর কাতর হয়ে সারা না দিয়ে পারেননি । তিনি তাঁর জৈষ্ঠপুত্র সান্তোষচন্দ্রকে পাঠান রবীন্দ্রনাথের এই আবাসিক বিদ্যালয়ে -শান্তিনিকেতনে ।
অতঃ পর এই সান্তোষচন্দ্র,কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও আরো গুটি তিনেক ছাত্র মিলে মোট পাঁচজন ছাত্র নিয়ে শুরু হয়েছিল শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় ।পরে পরে বহু চেষ্টায় এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ শিক্ষাদান ও সাহচর্যের আকর্ষনে ছাত্রসংখ্যা ক্রমশ বর্ধিত হতে থাকে ।
কেমন ছিল এই ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় আর নিয়ম কানুন তা জানতে হলে এক প্রথিতযশা ছাত্রের জবানবন্দির আমাদের দৃষ্টি নিবন্ধ করতে হবে । পরে পরে বহু চেষ্টায় এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ শিক্ষাদান ও সাহচর্যের আকর্ষনে ছাত্রসংখ্যা ক্রমশ বর্ধিত হতে থাকে ।
কেমন ছিল এই ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় আর নিয়ম কানুন তা জানতে হলে এক প্রথিতযশা ছাত্রের জবানবন্দির আমাদের দৃষ্টি নিবন্ধ করতে হবে ।সেটা এই -কেউ বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে একটি ছাপা নিয়মাবলী বিস্তারিত জানিয়ে দেওয়া হত ।আবাসিক প্রতিটি ছাত্রের নিরামিষ আহার,সুতির গেঞ্জি তিনটি ,গরম গেঞ্জি একটি ,পাঞ্জাবি অথবা শার্ট তিনটি ,গামছা দু খানি ,স্ট্রানজি একটি ,তোষক একটি ,মশারি একটি ,মাথার বালিশ একটি ,বিছানার চাদর ও বালিশের ওয়াড় দুটি ,লেপ অথবা কম্বল একটি ,আর পট্টবস্ত্রের জোড় ।সঙ্গে বাসন কোসনের তালিকায় দেওয়া থাকত ।গরু একটি ,থালা বাটি ও গেলাস একটি করে ,আর সঙ্গে নিতে হবে পোশাক -আশাক ও প্রয়জনীয় জিনিসপত্র রাখতে ছোট টিনের বাক্স একটি ।এইখানেই শেষ নয় ।আর একটি কাঠের বাক্সে ছাত্রকে নিতে হবে করাত ,হাতুড়ি ,বাটালি ,তুরপুন্ প্রভৃতি হস্তশিল্পের নানাবিধ যন্ত্রপাতি ।

 

ছাত্রদের দিন শুরু হতো সূর্য উঠবারও আগে। ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে নিজের নিজের বিছানাপত্র গুছিয়ে, ঘরদোর স্বহস্তে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে স্নান সেরে নিতে হতো। এরপর পট্টবস্ত্র ও উড়নী গায় দিয়ে প্রস্তুতি নিতে হতো প্রাত্যহিক উপাসনার জন্য। নির্দিষ্ট সময়ে ঘণ্টা পরলেই দেখা যেত ঘড়ি ধরে ঠিক সময়মত গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ শালবীথির প্রান্তরের মাঝে লাল কাঁকরের পথ ধরে বাসভবন ‘দেহলি’ থেকে ধীরে ধীরে হেঁটে আসছেন ছাত্রদের সঙ্গে সমবেত উপাসনায় যোগ দিতে। ছাত্ররা সব সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে যেত। ছাত্রদলের দিকে মুখ করে রবীন্দ্রনাথ হাতজোড় করে প্রার্থনা করতেন— ‘ওঁ পিতা নোহাসি ! পিতা নো বোধি’। প্রার্থনা শেষে তিনি সকলকে আশীর্বাদ করতেন ।
উপাসনার পর পোশাক পরিবর্তন করে ছাত্রদল প্রাতরাশ গ্রহণ করতো । প্রাতরাশে থাকত ভিজানো ছোলা বা মুগডাল। সঙ্গে আখের গুড় ও আদাকুচো । এরপর কোনদিন বোঁদে ,কোনদিন জিবে গজা, কখনো কখনো মোহনভোগ । শেষে দু হাতা গরম দুধ। এরপরই ক্লাস শুরু হতো। সকালের প্রথম দফা ক্লাস চলত বেলা এগারোটা পর্যন্ত। গুরুদেব স্বয়ং ছাত্রদের বাংলা ও ইংরেজি ক্লাস নিতেন । তারপরেই মধ্যাহ্নের আহার। মধ্যাহ্নের আহারের তালিকাটি এইরকম : ভাতের সঙ্গে চা- চামচের দু’চামচ ঘি , একটা যে কোন ডালে, আর সঙ্গে প্রতিদিন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আলুভাজা, ঢ্যাঁড়সভাজা , পটলভাজা ,কুমড়োর ছক্কা ,কড়া করে সাঁতলানো আলুর ঝোল । কখনো কখনো আলুপোস্ত বা পেঁয়াজপোস্ত । খুবই সাদামাটা ও অনাড়ম্বর খাওয়া-দাওয়া। রাতের আহারও প্রায় একই রকম। তবে রাতে ছাত্রদের নিজের নিজের রুচি অনুযায়ী ভাত ও রুটির দু’রকম বন্দোবস্তই থাকত।আর দু,হাতা দুধ নিত্যই আহারের পর পাওয়া যেত।

দিনের আহারে মাঝে মাঝে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের সঙ্গে পঙক্তি ভোজনে বসে যেতেন। ছেলেদের তখন আনন্দের সীমা থাকত না। এরপর বিকালে পুনরায় ঘণ্টা-দুই নানা বিষয়ের ক্লাশ শুরু হতো। বিদ্যালয় এর অন্যান্য আচার্যরা সে সব ক্লাস নিতেন। বিকালের এই  ক্লাসের পরেই জলযোগ সেরে ছেলেরা দলবেঁধে খেলার মাঠে ছুটতো । ফিরে ছেলেদের আর পড়াশোনায় বসতে হতো না তখন হতো নানা রকম বিনোদনপর্ব । গান-বাজনার চর্চা। গুরুদেবের লেখা নানান গান  ছাত্রদের শেখাতেন  ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভান্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সঙ্গে থাকতেন অন্যরাও।

প্রতি বুধবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ওই দিন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত  উপাসনা মন্দিরে বিশেষ উপাসনা হতো। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ উপাসনা শুরুর আগে মন্দিরের বড় ঘন্টা বাজিয়ে আশ্রমের সকলকে উপাসনা আসার আহ্বান জানাতেন। উপাসনার প্রারম্ভে তার সুললিত কণ্ঠে উচ্চারিত হতো———

ওঁ যো দেবাহগ্ন যোহপ্সু

যো বিশ্বং ভুবনমাবিবেশ

য ওষধিষু যো বনস্পতিষু

তস্মই  দেবায় নমো নমঃ ।

গুরুদেব  রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে এই  উদাও প্রার্থনা শিশুমনের অন্দরে এক অনির্বচনীয় আধ্যাত্মিকতার সুর জাগিয়ে তুলত। মানব জীবনের যে মূল ভিত্তিভূমি তা  অজান্তেই সেই সময় গড়ে উঠত করে প্রতিটি  ছাত্রের দেহ ও মনে। প্রকৃতির খোলামেলা রূপ- বৈচিত্র্যের মাঝে প্রাচীন ভারতের আধ্যাত্মিক সুরের মেদুরতা একটা মানব শরীর ও মনের সর্বাঙ্গীন গঠন- প্রক্রিয়ায় চিরকালীন ছাপ রেখে যেত, যা ভবিষ্যৎ জীবনে ছাত্রদলের বিরাট পাথেয় হয়ে উঠত।

রবীন্দ্রনাথের এই ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় এর প্রচার কালে কালে সারাদেশে পরিব্যক্ত হয়। সামান্য কটি ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু, কয়েক বছরের মধ্যে তা বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়। নানা দেশ থেকে নানা ভাষাভাষী ছাত্রদল এসে শান্তিনিকেতনকে  পরিপুষ্ট করে তোলে। রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন একটা নির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহের দিকে এগিয়ে চলে। অবশেষে, সূচনাকালের  ঠিক ২০ বছর বাদে বাংলার ১৩২৮ সালের ৭ পৌষ এই ব্রম্ভাচার্যশ্রম  বিদ্যালয় ‘বিশ্বভারতী’ -রূপে আত্মপ্রকাশ করে সমগ্র ভারত তথা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

 দোলগবিন্দ  মুখোপাধ্যায়

[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *