[:bn]শ্মশানের কুহকী[:]

[:bn]শ্মশানের কুহকী[:]

January 12, 2018

[:bn]আচমকা ঘুম ভেঙে গেল রিনার । কেমন একটা অস্বস্তি লাগছে। কোনো কারণ নেই অস্বস্তির। ঘুম ভাঙ্গারও কারণ নেই ।হঠাৎ টের পেল ,কে যেন জুতো পায়ে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠল। তারপর ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এলো দরজার দিকে। ঘরে তখন যে জ্বলছে ডিম লাইট। তাতে ঘড়ির কাটা বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রাত দুটো বাজে। একটা ঊনষাট নয়, দুটো এক ও নয় ।ঠিক তখনই দরজায় পরপর তিনটে টোকা পড়লো ঠক ঠক ঠক ।চমকে উঠল ও ।এত রাতে কে এল? কারো তো আজ ওদের ওখানে আসার কথা নেই ।একবার ভাবল জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু পরে ভয় করতে লাগলো। ভাবল, দেখি আবার টোকা দেয় কি না।কিন্তু না টোকা আর পড়লো না । অনেকক্ষণ কেটে গেল। তারপর একসময় ঘুমিয়ে পরলো সে ।সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হলো বেশ। মা ওকে ধাক্কা দিয়ে বললেন, ক্লাশ শুরু হতে মোটে এক ঘন্টা বাকি। এখনো ঘুমই যে ভাঙলো না।
তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠল সে। তৈরি হয়ে যেতে যেতে ক্লাস শুরুর সময় হয়ে গেল। অবশ্য কোনো রকমে ক্লাসটা ধরতে পারল।ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে আসার পথে সে ভাবতে লাগলো কাল রাতের ঘটনাটার কথা ।বাবার বদলির চাকরি। দিনাজপুর থেকে বদলি হয়ে এসেছেন তিনি।সঙ্গে ওদের পুরো পরিবার। তাই এই শহরে নতুন এসেছে ওরা। বাবার অফিসের লোকজন মিলে বাড়ির খুঁজে দিয়েছে। জায়গাটা আগে শহরের বাইরে ছিল। এখন অবশ্য শহরের ভেতরেই। তবে জনবসতি অনেক কম। ওদের বাড়িটার আসে পাশে কোন বাড়ী নেই। বাড়িঘর যা আছে তা বেশ দূরে। ওদের বাড়ির সামনে রাস্তা। আর রাস্তার ওপরে একটা পুকুর ।সে পুকুরে কেউ স্নান করে না ।শ্যাওলায় ভরা সেই পুকুর ।বাড়িটা খুব বেশি বড়ো নয় ।তবে চলনসই ।দু,ভাইবোনের মধ্যে ও বড়ো ।ছোট ভাই তা ভেতরের ঘরে মা বাবার সাথে থাকে ।

 

রিনার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে বাইরের ঘরে। ঘরটায় দুটো দরজা। একটা বাইরে ,আরেকটা ভেতরের দিকে। বাইরের দরজা খুললেই ছোট্ট একটা বারান্দা। সিঁড়ি বেয়ে বারান্দা থেকে নামলেই পথ। নিশ্চয় রাতে যে এসেছিল সে রাস্তা দিয়ে এসেছে। তবে রাস্তায় হাটার শব্দ সে পায়নি। পেয়েছে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার এবং বারান্দায় হেঁটে আসার । টোকা দেওয়ার পরও যখন ও দরজা খুলল না, তখন নিশ্চয় লোকটা চলে গিয়েছিলো। অথচ চলে যাওয়ার সময় পা ফেলার কোন শব্দই হয়নি, কিন্তু আসার সময় স্পষ্ট শোনা গিয়েছিল জুতোর মচমচ শব্দ।
দ্বিতীয় রাতে কেন জানি ঘুম পেল বেশ তাড়াতাড়ি।ক্লাসে পড়ার চাপ কম ছিল। তাই রাতের খাবার পরপরই শুয়ে পডল রিনা ।ঘুমোলোও অনেকক্ষণ। কিন্তু এক সময় হঠাৎ করেই ভেঙ্গে গেল ঘুম। ভাঙলো একটা আওয়াজে । সেই একই আওয়াজ ।ঠক ঠক ঠক ।ঠিক তিনবার দরজায় টোকা পড়লো। তবে এপরও সাধারন ঠক ঠক নয়। কুম্ভকর্ণের নিদ্রাও যদি হয়, তবুও ভেঙে যাবে, এমনই তীব্র সে আওয়াজ। অবশ্য শুধু এই তিনবার। তারপর থেমে গেল। অনেকক্ষন চলে গেলও যে টোকা দিয়েছে তার চলে যাওয়ার কোনো আওয়াজ পাওয়া গেল না। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই চোখদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল। রাট ঠিক দুটো বাজে ।অবশ্য আজ সে আগন্তকের আসার সময় সে ঘুমিয়ে ছিল বলে আসার সময়কার পায়ের আওয়াজ শোনার সুযোগ সে পায়নি।

 

খুব সাহসী মেয়ে বলে দ্বিতীয় দিনের ব্যাপারটা কেও মনের ভুল বলে ধরে নিল। তাই তৃতীয় রাতে পড়াশোনা শেষ করে ডিম্ লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পরলো সে। কত রাত পর্যন্ত ঘুমিয়েছে তা বলতে পারবেনা, কিন্তু কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ওর ছোট ভাই যখন খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো তখন আর ওর পক্ষে ঘুমিয়ে থাকা সম্ভব হলো না। আরামের ঘুমটা ভেঙ্গে যাওয়ায় বড্ড বিরক্ত হল । চোখ মেলে দেখলো ওর বিছানার পাশে দাঁড়িয়েই ছোট ভাইটা হি – হি করে হাসছে। হাসতে হাসতেই ভাইটা বললো তোমার ঘুমটা একটু ভাঙিয়ে দিলাম আর কি……
তারপর ছোট ভাইটা ছুটে গেল পাশের ঘরে। ঠিক তখনই জুতোর মচমচ আওয়াজ তুলে বারান্দায় উঠে এলো আগন্তুক এবং তার পরপরই দরজায় একের পর এক তিনটে টোকা পড়ল । এরপর সব শুনশান। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত তখন দুটো । পরদিন সকালে ছোট ভাইটাকে ধমক দিয়ে বলল সে ,আর কখনও এমন বজ্জাতি করবে না।
ভাইটা তো ব্যাপারটা শুনতেই আকাশ থেকে পড়ল। বলল, আমি তোমার ঘরে এলাম কখন? সারারাতই তো আমি ঘুমিয়েছি।
রিনা ধরে নিল ভাইটা দুষ্টুমির কথা স্বীকার করছে না । বাবা যে কড়া মানুষ। শুনলে ওকে পিটুনিও দিতে পারেন। তাই আর কথা বাড়ালো না ।তবে দরজায় টোকা পড়ার ব্যাপারটা রহস্যেই ঢাকা থাকল ।ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে ও ঠিক করল যে, আজ রাতে জেগে থাকবে এবং চেষ্টা করবে রহস্যের কুলকিনারা করার। সেই মতো জেগেও রইল। কিন্তু রাত ১১.৩০ টার দিকে ভীষণ ঘুম পেল ওর । এমন ঘুম, যেন একেবারে হুঁশই হারিয়ে ফেলবে । তবুও কোনমতে উঠে গিয়ে চোখে জল দিল । তারপর কড়া লিকারের চা বানাল। এক মগ চা খাওয়ার পর নিজেকে একটু সতেজ মনে হলো। এবারে টেবিলে এসে বসলো। ক্লাসের পড়া আগেই তৈরী হয়ে গিয়েছিল। তাই গল্পের বই নিয়ে বসলো।

 

এভাবেই রাতের প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হলো। কাছাকাছি কোন জায়গা থেকে একটা শিয়াল হঠাৎ করে ডেকে উঠলো। কিন্তু বেশ আশ্চর্যজনকভাবে অন্য কোন শিয়ালই তার সঙ্গে সুর মেলালো না । এরপর কেটে গেলো আরো প্রায় 2 ঘন্টা । তারপর নিশুতির নিস্তব্ধতা ভেঙে উৎকটভাবে ডেকে উঠলো একটা পেঁচা ।আর তখনই সেই অচেনা আগন্তুক জুতোর মচমচ আওয়াজ তুলে সিড়ি বেয়ে উঠে এলো বারান্দায় । তারপর দরজায় পড়ল তিনটে টোকা —-ঠক ঠক ঠক। দ্রুত দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল সে। দেখল রাত ঠিক দুটো বাজে। ঘরে আলো জ্বালানোই।তাই সাহস তার অন্য দিনের চেয়ে একটু বেশিই ছিলো। কোন কিছু না ভেবে দ্রুত সে ছুটে গেলো দরজার দিকে। সঙ্গে খুলে ফেলল দরজা। দরজা খুলতেই হিমশীতল একটা হওয়া ছুঁয়ে গেলো ওকে । চৈত্রের রাতে এমন মাঘের বাতাস যে কোত্থেকে আসতে পারে তা ওর মাথায় এল না। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখল , শুধু বারান্দা কেন ,সামনের রাস্তা , এমনকি দূরের বাড়িটা পযর্ন্ত কোথাও কেউ নেই। তাহলে দরজায় টোকা দিল কে ?
ব্যাপারটা ভাবতেই আতঙ্কে হিম হয়ে গেলো সে । হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আর্তনাদ করে জ্ঞান হারাল। চিৎকার শুনে ভেতর থেকে বাবা-মা ছুটে এলেন। জ্ঞান ফেরার পর ওকে অনেক বকাবকি করলেন দরজা খোলার জন্য।এরপর কয়েক দিন ভেতরের ঘরে গিয়ে মায়ের কাছে শুল সে । তারপর কিছুদিনের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেল। রিনা আবারও থাকতে শুরু করল বাইরের ঘরে ।এক রাতে বেশ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল ও ।পড়ার চাপও তেমন ছিল না। তার ওপর কেমন একটা ঘুমঘুম লাগছিল। শোয়ার পর মনে হল কে যেন ঘরে ঢুকেছে ।ও অনুমান করলো এই নিশ্চয় ওর ছোট ভাই এর দুষ্টুমি। বিছানায় উঠে বসতেই ও দেখল,ওর ছোট ভাইটাই ফিকফিক ফিকফিক করে হাসতে হাসতে ভেতরের দরজা দিয়ে পাসের ঘরে দিকে ছুটে গেল। ও ঠিক করল, এতো রাতে আর কিছু বলবে না। কাল সকালে আচ্ছা রকমের বকুনি দিয়ে দেবে ।
এবারে বিছানায় গা এলিয়ে দিল বেশ নিশ্চিন্তে। তারপর গভীর ঘুম। কতক্ষন ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না। হঠাৎ করেই ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ওর মনে হলো ভেজা বিছানার উপর শুয়ে আছে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো দেহটাই জলে ভেজা তোশকের উপর রাখা আছে। কিন্তু এমন তো হবার কোনো কারণই নেই। চোখ মেলে তাকালো ও। আর ছাদের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল, ছাদ কোথায়? ওপরে আকাশ। যেখানে ফুটে আছে লক্ষ লক্ষ তারা। আশপাশ থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁর ডাক।

 

তখনি ও অনুভব করল, ওর পা জোড়া যেন ডুবে রয়েছে জলে । তাড়া তাড়ি পায়ের দিকে তাকাতেই দেখল ,সত্যি ওর পাদুটো ডোবানো রয়েছে জলে । আর ও শুয়ে রয়েছে ওদের বাড়ির সামনের পুকুরের গা ঘেঁষে জল-কাদায় মাখামাখি একটা জায়গায়। ওঠার জন্য ও ঘাড় উঁচু করতে যাবে, এমন সময় যে দৃশ্য দেখল তাতে ভয়ংকরভাবে আঁতকে উঠলো সে । দেখল ওই শ্যাওলা ভরা পরিত্যক্ত পুকুরের মাঝখানে এলোমেলো চুলের এক নারী গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আস্তে আস্তে ডুব দিল সে গভীর জলে। অমন পুকুর এই গভীর রাতে কোন মানুষের পক্ষে যে ডুব দেওয়া যে অসম্ভব তা বুঝতে বাকি রইল না ওর । ব্যাপারটা ভাবতেই ওর মেরুদন্ডের ভেতর দিয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। আর ঠিক তখনই একইসঙ্গে ডেকে উঠল ঐ প্যাঁচাটা এবং শেয়ালটা।
রিনা মরন চিত্কার দিয়ে ছুটে গেল বাড়ির দিকে । আর বারান্দায় যেই না পা রাখতে যাবে অমনি দেখল, বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ওর ছোট ভাই। খিলখিলিয়ে হাসছে সে তারপর শূন্যে দুটো ডিগবাজি দিয়ে মিলিয়ে গেল হওয়ায়। ও ছুটে গেল ভেতরের ঘরে। দেখল ,ওর ছোট ভাই মা -বাবার সঙ্গে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে । ওর চিৎকারে মা -বাবা ছোট ভাই সবার ঘুম ভেঙে গেল।
একটু পরেই ভোর হলো। রাতে চিৎকারের আওয়াজ বহুদূর পর্যন্ত গিয়েছিল। দূরের বাড়ির কারো কারো ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল । সেসব বাড়ির লোকেরা ভোরেই ওদের বাড়িতে এল। তারা জানাল , ওদের বাড়ির সামনের গাছতলায় বহুকাল আগে শ্মশান ছিল। এই পুকুরটা ছিল ওই শ্মশানের পুকুর। সেখানে নাকি এক মায়াবিনীর বাস। তাকে বলে কুহুকি। তার ছলনায় পড়ে বহু মানুষের অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে ।আর ওরা যে বাড়িতে আসে উঠেছে সেখানে মানুষ টিকতে পারে না ।

খন্দকার মাহমুদুল হাসান

[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *