সেলিব্রিটিদের অনুকরণ করা ঠিক? কিরকম হওয়া উচিত তাঁদের আচরণ?

সেলিব্রিটিদের অনুকরণ করা ঠিক? কিরকম হওয়া উচিত তাঁদের আচরণ?

February 23, 2018

[:bn]অনিচ্ছুক অঙ্কিতকে ওর উদ্বিগ্ন বাবা-মা আমার কাছে এনেছেন। বেসরকারি কলেজে প্রথম বর্ষ ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র– বয়স ১৯। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ইদানিং লেখাপড়ায় মন নেই। প্রায় রাতে ফেরে না — বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে পার্ক স্ট্রিটে তন্ত্র’তে নাচগান করে’ মদ ও গাঁজা খায় , বাড়িতে বাবা -মা নিষেধ করলে বিরক্ত হয়।রাগ দেখায় , এমন কি আত্মহত্যা করবে বলে ভয় দেখায়। ওর সঙ্গে আলাদা করে কথা বললাম। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছা কোনোদিনই নেই। অভিনয়কে ও পেশা হিসেবে নিতে চায়–মুম্বাই যাওয়ার ইচ্ছা।
‘ অভিনেতা হতে গেলে কি নেশা করতে হবে?’
উত্তরে বললে, ‘সলমান, ঋত্বিক সবাই ড্রিংক করে, নাচে, পার্টি করে –তবে আমাকে কেন বারণ করা হচ্ছে?
প্রিয়াঙ্কার বয়স ১৭। হায়ার সেকেন্ডারি পড়ছে।গত বছর সময় কোন এক প্রসাধনসামগ্রীর আয়োজিত সুন্দরী প্রতিযোগিতায় বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে।ওর মায়ের কথা হল তারপর থেকে মেয়ে ‘ মডেলিং’ করতে চায়– এর জন্য নানাজনের সঙ্গে দেখা করে।বাবা-মা যখন নাগাদ টাকা ও অনেক গিফট পেয়েছিল খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু এখন মেয়ের চালচলন ভাল লাগছে না। কি রকম অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। সারাক্ষন সেলফোনে কথা বলে চলেছে ।তারপর বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি বলে দু ‘দিন বাড়ি থেকে বাইরে থাকে ।হঠাৎ হাতে চার-পাঁচটা ব্লেডের কাটা দাগ দেখে বাবা -মা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কথা বলে জানলাম একটি ছেলে মডেলিং-এর ভালো সুযোগ করে দেবে বলে ঠকিয়েছে।দু ‘দিন তারা বাগুইহাটির কাছে একটি লজে কাটিয়েছে। এখন হতাশায়, রাগে সে হাতে ব্লেড দিয়ে কেটেছে । কারণ সে মডেলিং করে নাম-ঐশ্বর্য-এর চূড়ায় উঠতে চায়— তার লক্ষ্য ছিল ‘সেলিব্রিটি ‘ হওয়া । আশাভঙ্গের জন্য সে আর বাঁচতে চায় না।
আমাদের চারপাশে এরকম অনেক অঙ্কিত,প্রিয়াঙ্কাদের মতন কিশোর-কিশোরীরা রয়েছে।তারা যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত, প্রাণচঞ্চল, কিন্তু ‘সেলিব্রিটি ‘ হবার মোহে, ভবিষ্যৎ জীবনের রঙিন স্বপ্নের কথা ভেবে বাস্তবকে ভুলে যায়। নিজেদের কেরিয়ার, পরিবারের কথা এতটুকু না ভেবে উন্মত্তের মতো ছুটতে থাকে।
‘সেলিব্রিটি ‘ কথাটির সহজ মানে হল শিল্প,সাহিত্য,সংস্কৃতির জগতে বা অন্যান্য প্রফেশনে যারা খুব সমাদৃত হন, প্রতিষ্ঠা পান । সাধারণ মানুষেরা তাদের সাজ-পোষাক, কথাবার্তা, চালচলন সবকিছুই অনুকরণ করতে চায়। অনেক সময় এই সেলিব্রিটিরা তরুণ-তরুণীদের ‘রোল মডেল’হয়ে যান । সেলিব্রিটিদের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধেও সাধারণ মানুষের মনে অনেক কৌতুহল থাকে। এখনকার সময়ে মিডিয়া , বিশেষ করে টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে নায়ক-নায়িকা বা তারকাদের দেখা যায়। তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক গোপন কথাও জানা যায়।কিশোর-কিশোরীদের এ বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহ থাকে।
বর্তমান যুগে আমাদের সমাজ জীবনেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। পশ্চিমী সভ্যতা বা কালচার আমরা সাদরে গ্রহণ করেছি। ভোগবাদ ও উচ্চ মানের পণ্যপ্রীতি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে শোবার ঘর থেকে রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছে। এছাড়া বিজ্ঞাপন এখন আমাদের জীবনকে খুব বেশি করে প্রভাবিত করেছে। এসবের প্রভাব আমাদের ছেলেমেয়েদের মনে মোহ ও বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।
আগেকার দিনেও সেলিব্রিটিরা ছিলেন। সিনেমা, ক্রীড়া, জগতে অনেকেই তখনকার ছেলেমেয়েদের মনকে প্রভাবান্বিত করেছেন। উত্তম কুমার থেকে শুরু করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দেবানন্দ থেকে কিশোর কুমার ,মান্না দে বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যথেষ্ট নামীদামী শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। সুচিত্রা সেন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, এক সময় অবশ্যই সেলিব্রিটি ছিলেন। কিন্তু তখন এত টিভি চ্যানেল বা পত্র-পত্রিকা ছিল না।ছিল উল্টরথ,সিনেমাজগ আর নবকল্লোল।এই সব পত্রিকাতেই যেটুকু নায়ক-নায়িকা ও শিল্পীদের নিয়ে লেখা দেখা যেত। অনেক শিল্পীই খুব সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করতেন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। লতা মঙ্গেসকার থেকে রফি ,কপিল দেব বা গাভাস্কার কম জনপ্রিয় ছিলেন না। কিন্তু তাদের নিয়ে মানুষকে উশৃংখল হতে দেখা যায়নি। এসব সেলিব্রিটিদের জীবনযাত্রায় কোন লোক দেখানো চমক ছিল না, ছিল নিয়মানুবর্তিতা, কঠোর অনুশীলন ও দায়বদ্ধতা। আগেকার দিনের অনেক সেলিব্রিটির জীবনের সরলতা,আড়ম্বরহীন জীবনযাত্রা সাধারণ মানুষকে প্রভাবান্বিত করেছে।
আমরা জানি প্রায় প্রত্যেকেই নাম চায় । নিজেকে ভালোবাসে বলেই চায় সকলেই তাকে দেখুক, জানুক। আর তার সঙ্গে অনেকে চায় উদ্দাম গতিবেগ।এমনিতেই যৌবন বেগবান , সুতরাং কিশোর-কিশোরীরা চায় তীব্র গতি, সকলকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে। গতির নেশা অনেক সময় কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের বেপরোয়া করে তোলে । এই লাগামছাড়া গতিবেগে ভয় আছে , দুর্ঘটনা ঘটতে পারে— তবুও কিশোর-কিশোরীরা মেতে ওঠে। যৌবনকে উপভোগ করতে, রঙিন করে তুলতে,গতির নেশা বেপরোয়া, বেহিসাবি করে তোলে। হেলমেটবিহীন অসম্ভব গতিতে মোটর বাইক চালাতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে শোচনীয় দুর্ঘটনা। প্রাণ যাচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের। দুরন্ত গতিতে মোটর গাড়ি চালাতে গিয়েও প্রাণসংশয় হচ্ছে। বিশেষ করে মদ্যপান করে বন্ধু-বান্ধব মিলে প্রচন্ড গতিতে গাড়ি চালিয়ে পথচারীরা যেমন আহত বা নিহত হচ্ছেন তেমনি চালক বা সঙ্গীদেরও জীবন বিপন্ন হয় । সম্প্রতি সিনেমার এক উঠতি নায়ক বিভিন্ন বার -হোটেলে মদ্যপান করে সঙ্গিনীকে নিয়ে দুর্বার গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন। সঙ্গিনী মারা গেছেন। এখনকার দিনে মদ্যপান শুধু সমাজ স্বীকৃতই নয়, স্ট্যাটাসে পরিণত হয়েছে। ঘরে ঘরে চা কফির বদলে অতিথি আপ্যায়নে ড্রিংক্স দেওয়া হয়, আধুনিক বাবা -মায়েরা ছেলেমেয়ের সামনে, অনেক সময় একসঙ্গে সুরাপান করেন। তাছাড়া টিভি সিরিয়াল বা সিনেমায় মিডিপেন দৃশ্যের ছড়াছড়ি।তা দেখে নায়ক -নায়িকাদের নকল করতে গিয়ে অনেক ছেলে মেয়ে বন্ধুবান্ধব মিলে বার্থডে পার্টিতে বা নানা অনুষ্ঠানে মদ্যপান করেন।অল্প পরিমাণ মদ মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে দেয় কিন্তু তা সাময়িক। রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা বাড়তে শুরু করলে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অবশ্য তা নির্ভর করে যে মদ্যপান করছে তার শারীরিক আর মানসিক অবস্থার ওপর।আবার পরিবেশও অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। মদ্যপান বেশি অর্থাৎ রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা বাড়লে তা মস্তিস্কের সচলতাকে বিঘ্নিত করে। কথাবার্তা, চালচলন অসংলগ্ন হয়ে পড়ে। বিচারবুদ্ধির তীক্ষতা কমে যায়। এর জন্য অতিরিক্ত মদ্যপান করে গাড়ি চালানো খুবই বিপদজনক– নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে যে কোন সময়।
অনেকেই ভুলে যায় আমরা সেলুলয়েডের পর্দায় যা দেখি তা সবসময় বাস্তবাযুগ হয় না।নায়ক নায়িকাদের যে জীবন দেখানো হয় তা সত্যি নয়। অনেক অনুরাগী বা ‘ফ্যান’ তার প্রিয় নায়ক নায়িকাকে অনুকরণ করতে গিয়ে অসুবিধা ও বিপদের সম্মুখীন হয়। বাস্তব জীবন অনেক কঠিন। সেখানে লড়াই করে সংগ্রাম করে বাঁচতে হয়। আর সেলিব্রিটিদের অনেক কষ্ট, হতাশা থাকে। বাস্তব জীবনে অনেক প্রতিভাবান নামি শিল্পী কষ্ট করেছেন, লড়াই করে তবে সফলতা পেয়েছেন।
সত্যজিৎ রায় ‘নায়ক’ সিনেমায় একজন নায়কের হতাশা ব্যর্থতা ও নিঃসঙ্গতা সুন্দর করে দেখিয়েছেন।নিঃসঙ্গতা বড় নির্মম অবস্থা।পরিবার সংসার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে শুধু নিজের কল্পনা, স্বপ্নের জগতে বা অতিরিক্ত নাম , অর্থ নিয়ে ভাবতে গেলে একাকিত্ব তীব্র হয়। মানসিক দিক থেকে হতাশার শিকার হতে হয়।
নিজেকে ভালোবাসা বা ‘আত্মপ্রেম’ স্বাভাবিক মানসিক অবস্থা। কিন্তু নিজের প্রতি অনুরাগ, ভালবাসা কখনো কখনো এত তীব্র হয় যে মানুষ সবকিছু ভুলে শুধু নিজেকে নিয়েই মেতে থাকে। একে ‘নার্সিসিজম’ বলে। সেলিব্রিটি হবার আকর্ষণে অনেক ছেলেমেয়েই নিজের সাজপোশাক, সাজসজ্জা নিয়ে বিভোর হয়ে সবকিছু ভুলে যায়। তাদের লেখাপড়া, ভবিষ্যৎ সবকিছুই অবহেলিত হয়। এ বিষয়ে অভিভাবকদের যেমন সতর্ক হতে হবে তেমনি ছেলেমেয়েদের ভাবতে হবে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সারাক্ষণ দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা ঠিক নয়। একথা অনুভব করার সময় এসেছে।

ডঃ অমরনাথ মল্লিক(সাইক্রিয়াটিস্ট )

কি রকম হওয়া উচিত সেলিব্রিটিদের আচরন?কয়েকজন সেলিব্রিটিদের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিলেন— অংশুমান চক্রবর্তী

মনোজ মিত্র : প্রত্যেকেরই উচিত সুস্থ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা। তা তিনি সেলিব্রিটি হন আর যেই হোন। মানুষের বা সমাজের ক্ষতি হয় এমন কাজ কারোও  করা উচিত নয়। কিছু কিছু উঠতি সেলিব্রিটি মাঝেমধ্যে কিছু ভুল কাজ করে ফেলেছেন বটে তবে সেটা একেবারেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। নতুনই হন বা পুরোনো ,সব  সেলিব্রিটিই  কিন্তু এই ধরনের অন্যায় কাজ করেনা। ফলে একটা ঘটনা দেখে বিচার করা ঠিক হবে না।তবে হ্যাঁ প্রত্যেকেরই উচিত ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া। কেউ যেন এমন আচরণ না করে ফেলেন, যাতে অন্যের ক্ষতি হয় এই বিষয়টা সব সময় মাথায় রাখতে হবে।

অপরাজিতা আঢ্য  :  সেলিব্রিটি বা নন সেলিব্রিটি বলে কথা নয়, প্রত্যেক মানুষেরই আচরন সংযত হওয়া উচিত।অসংযত আচরণ কারোরই করা উচিত নয়। মান আর হুঁশ যাদের আছে তারাই তো মানুষ। ফলে দেখতে হবে কারো দ্বারা অন্যের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।ভদ্র এবং স্থির হতে হবে প্রত্যেককেই। তবে একটা কথা সাধারন মানুষ যাদের অনুকরণ ও অনুসরণ করেন, সেই সব সেলিব্রিটিদের সমাজের প্রতি বিশেষ দায়িত্ব থেকেই যায়। ফলে সবসময় সচেতন থাকতে হবে, কোনোভাবেই তারা যেন ভুল কাজ না করে ফেলেন । তাঁদের পদস্খলন হলে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। বিশৃঙ্খল জীবনযাপন বা উচ্ছৃংখল আচরণ দূরে সরিয়ে প্রত্যেককেই শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে দিন কাটাতে হবে, তবে সমাজের মঙ্গল।

মনোময় ভট্টাচার্য : একজন সেলিব্রিটি কে আগে নম্র এবং ভদ্র হতে হবে। তাঁর এমন কোন আচরণ করা উচিত নয় যেটা দেখে সাধারণ মানুষ মনে আঘাত পান। কোনো মানুষের সঙ্গেই  খারাপ ব্যবহার করা উচিত নয়,কাউকে অহংকার দেখানো উচিত নয়। মনে রাখতে হবে এঁদের ভালোবাসা পেয়েই একজন মানুষ  সেলিব্রিটি হয়ে ওঠেন। অনেকেই একটু  বিখ্যাত হয়ে গেলে ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। খারাপ ব্যবহার করে বসেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। এটা একেবারেই ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে এঁদের ভালোবাসা, সমর্থন সরে গেলে একজন সেলিব্রিটি আর পাঁচজনের মতই সাধারণ মানুষ হয়ে যাবেন। নতুনদের এই কথাগুলো বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে।[:]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *