[:bn]১৪ এপ্রিল [:]

[:bn]১৪ এপ্রিল [:]

March 23, 2018

প্রথম ভোরে এক ঝাঁক পাখির কল-কাকলিতে দামিনীর মায়ের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলতেই পুবের জানালা দিয়ে এক ঝলক সোনা রোদ্দুর মুখে এসে পড়ে। এই পাখিগুলো দামিনীর খুব কাছের ছিল। সকালে উঠে ছোলা খেতে দিত। পুকুরপাড়ের কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে ডালে ওদের বাসা। দামিনীর বাবা তখনো ঘুমে অচেতন।
ধাক্কা দিয়ে দামিনীর মা বলে,’আরে , ওঠো, ওঠো, বাজারে যাও। আজ না ১৪ এপ্রিল।
দামিনীর বাবা ধড়ফড় করে উঠে বসেন। ড্রেসিং টেবিলের একপাশে দামিনীর ফটো। সে দিকে তাকান। দামিনীর তখন ক্লাস নাইন। প্রথম শাড়ি পড়তে শেখে সে। হ্যাঁ ,প্রায় একঘণ্টা পর শাড়ি পড়া শেষ হয়েছিল।
তারপর হাসতে হাসতে বলেছিল, দাড়াও ড্যাড , তোমার সঙ্গে সেলফি তুলি ।
দামিনীর বাবার বুকের ভিতর চিন চিন করে ওঠে। এই যেন সেদিনের স্মৃতি।
দামিনী বাবা রুদ্রবাবু রিটায়ার্ড শিক্ষক। বাজারে গেলে পুরনো অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে দেখা হবেই ।
মাঝে মাঝে দামিনী বাবার সঙ্গে বাজারে যেত।কী বিরক্ত ! বাজারে লোকজনের মাঝে একজন ছাত্রী এসে ধপ করে পায়ে হাত দিয়ে বলতো, মাস্টারমশাই ভালো আছেন ? ব্যাস, এবার রুদ্রবাবুর প্রশ্নবাণ, এখন কি করছিস ?ছেলেমেয়ে কটা ? হাজব্যান্ড কেমন ? বাপের বাড়ি কবে এলি ?
দামিনী বাবাকে গুতো দিত। দেরী হয়ে যাচ্ছে।
দামিনীর বাবা হাসতেন। আরে আজ তো সানডে। তাড়া কিসের ? স্কুলে তো যাবি না।
আজ বাংলা নববর্ষের সুপ্রভাত। বাজারে ক্রেতা বিক্রেতার উপচে পড়া ভিড়। দামিনীর প্রিয় খাবারগুলো আজ ওর মা রান্না করবেই।পটলের দাম দ্বিগুণ। তা হোক, পটল দাও হে । দই দিয়ে পটল রাঁধা চাই। নটেশাকে কীটনাশকের গন্ধ। কিন্তু পেঁয়াজ দিয়ে নটেশাক ভাজা দামিনীর বড় প্রিয়। ছোটবেলা থেকেই দামিনী শুক্তো খেতে ভালোবাসে। উচ্ছে , বেগুন,সজনে ডাঁটা —এ -হে ব্যাগ ভর্তি।
মাছের বাজারে গিয়ে রুদ্রবাবু ভিড় ঠেলে ব্যাগ বাড়িয়ে দেন—বলাই দে, বড় বড় বাটা মাছ পাঁচশো দে তো। বাটা মাছ ভাজা দামিনীর চাই-ই চাই। রুদ্রবাবু অল্প করে চিকেনও নিলেন। তারপর মিষ্টির দোকানে পাঁচ -রকমের মিষ্টি, দই, ফল দোকানে পাঁচ রকমের ফল। প্রতি বছরের এই দিনটা রুদ্রবাবুর বাজার একদম ছকে বাঁধা। রুদ্রবাবু জিভ কাটেন । ইস্-স চিংড়ির মালাইকারি। চিংড়ি নিতেই হবে, নইলে দামিনীর মা রেগে যাবে।
তিনটে বাজারের ব্যাগ নিয়ে রুদ্রবাবুর হাঁসফাঁস অবস্থা। দামিনী ,একটা ব্যাগ ধর তো। বলেই একটা ব্যাগ বাড়িয়ে দিলেন।
কিছুক্ষণ পরে রুদ্রবাবুর সম্বিৎ ফেরে ,অরে এ তো দামিনী নয়। তাঁরই এক ছাত্রী, ব্যাগ হাতে তার পিছু পিছু আসছে। রুদ্রবাবু তার মাথায় হাত বোলান। কি আশীর্বাদ করি বল তো ? আমার কোনো আশীর্বাদ আর ফলে না। যাক ভালো থেকো। ভালো থাকা খুব কষ্টের, তবুও ভালো থাকার চেষ্টা কর।
চাপা যন্ত্রণায় রুদ্রবাবুর দম বন্ধ হয়ে আসে। রুদ্রবাবু বাড়ি ফিরে দেখেন দামিনীর মা স্নান সেরে ঠাকুরঘরে চোখ বন্ধ করে বসে। দুটো চোখ থেকে অশ্রুধারা টস টস করে কোলের উপর রাখা দামিনীর অ্যালবামের উপর ঝরে পড়ছে।
রুদ্রবাবু দামিনীর অ্যালবাম খোলেন। প্রথমেই দামিনীর শৈশবের তুলতুলে অবোধ মুখ। মাথায় ঝুটি চুল। তখন হামা দিচ্ছে। পাতা উল্টাতেই প্রথম হাঁটি-হাঁটি পা-পা। পরের পাতায় মুখে -ভাতের বেশ কিছু ঘটনার স্মৃতিচিত্র। কত আনন্দ, অতিশয্য, হৈ-হুল্লোড়। রুদ্রবাবুর চশমা ভিজে যায়। সময় কত দ্রুত ছুটে চলে। চশমার কাঁচ মুছে পৃষ্ঠা ওল্টাতে দামিনীর কে.জি ওয়ানের প্রথম দিনের ক্লাস। পরের পাতায় সারদা মিশন এর পোষাকে দামিনী। রুদ্রবাবু পৃষ্ঠা উল্টে যায়। দিঘায় স্নানের দৃশ্য। পুরীর সমুদ্র সৈকতে একা দামিনী। আবারও চোখ ভিজে যায়, পরের পাতার ছবি গুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যায়।
১৪ এপ্রিল এলে মেয়ের জন্য দামেনীর মায়ের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। নিজের হাতে রান্না করা চাই-ই। এই ব্যস্ততার মাঝে দামিনীর বন্ধুরা দলবেঁধে এল। সারা বছর ইতি উতি আসে কিন্তু এই দিন সবাই একসঙ্গেই আসে। হাতে বেলফুল আর তাজা রজনীগন্ধা। দামিনী বেলফুল খুব ভালোবাসত। ওরা এসে দামিনীর ফটো ফুলে ফুলে ঢেকে দিল। দামিনীর পছন্দের ধূপ জ্বেলে দিল।
দামিনীর মা কাঁদছে। বন্ধুরাও কাঁদছে। দামিনীর ঠোঁটে কিন্তু হাসি। রুদ্রবাবু নিজেকে সামলাতে পারলেন না, মেয়ের সামনে দাড়িয়ে বললেন-কিরে মা, হাসছিস ! আমরা সবাই তোর জন্য কাঁদছি আর তুই এমন করে হাসছিস ! দামিনীর বন্ধু লীনা বললে, ও হাসি আনন্দের নয় মাষ্টারমশাই, ও যে কষ্টের হাসি। হাসপাতালে আমাদের সঙ্গে শেষ দেখার দিনেও এই রকম করেই হেসে দামেনি বলেছিল, তোরা রইলি, আমি কিন্তু আসছি।
দামিনীর মা বললে, আসবে তো, অভাগী আজ ঠিক আসবে। ওর জন্যই তো এত রান্নাবান্না।
দামিনীর মায়ের স্থির বিশ্বাস ১৪ এপ্রিল গভীর রাতে দামিনী আসে। তাই সারাদিন রান্নাবান্না করে গভীর রাতে দামিনীর খাবার নিয়ে পুকুর ঘাটে গিয়ে দামিনীর উদ্দেশ্যে ভাসিয়ে আসে। দামিনীর মায়ের বিশ্বাস দামিনী ওর দেওয়া খাবার খায়।
রুদ্রবাবু দামিনীর মায়ের এই বিশ্বাসে কোনদিন আঘাত করেন না। বরং ১৪ এপ্রিল এলে দামিনীর মাকে সবরকম সাহায্য করেন। কন্যাহারা মায়ের যন্ত্রণা যদি খানিকটা লাঘব হয় এই আশায়।
প্রতিটি রোমকূপে সারাবছর সন্তান হারানোর যন্ত্রণা সুঁচ ফুটাতে থাকে। কোনো আনন্দ, কোনো সুখ, রুদ্রবাবু আর দামিনীর মাকে স্পর্শ করতে পারে না। শুধু এই একটা দিন দামিনীকে কাছে পাওয়ার অদম্য ইচ্ছা আর অলিক বিশ্বাস ওদের রক্তস্রোতে অন্য অনুভূতি ছড়ায়।
দামিনী ভালো গান গাইত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান। ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে……’
১৪ এপ্রিল রাত্রে নিকষ অন্ধকারে দামিনীর মা আর রুদ্রবাবু বিছানায় বসে থাকেন। যদি দামিনী ধীর পায়ে বারান্দায় এসে দু লাইন ফিস ফিস করে গেয়ে ওঠে। দুজনেই জানেন ব্যর্থ প্রতীক্ষা। তবু আকুল হয়ে প্রহর গুনে চলেন। রাত্রি গভীর থেকে গভীরতর হয়। অন্ধকারের নিজস্ব আলো থাকে। সেই আলো মেখে দামিনী আসে না। দামিনী তো আর কোনোদিনই আসবে না। আসতে নেই যে। ছ ‘বছর আগের ১৪ এপ্রিলে তাকে তো শেষ শয্যায় শায়িত করে চিরতরে বিদায় দেওয়া হয়ে গেছে। তবু কেন ১৪ এপ্রিল ফিরে ফিরে আসে। অসহায় বাবা মাকে নতুন করে কাঁদাতে।
রুদ্রবাবু দামিনীর মায়ের মাথায় হাত বোলান। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হতভাগিনী এক গর্ভধারিণী। ভোরের শীতল হাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছে। এবারের ১৪ এপ্রিল ফুরিয়ে গেল। আবারও এক বছরের দিন গোনা আজ থেকে শুরু হবে। ভোরের পৃথিবীর ঘুম ভাঙছে। ঘরে এখন শুধুই বাসি ফুলের গন্ধ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *